কেওক্রাডং ট্রেকিং

কেওক্রাডং বান্দরবান
শেয়ার করুন সবার সাথে

কেওক্রাডং ট্রেকিং কাহিনী 

(২য় এবং শেষ অংশ)

ছবি ও লেখকঃ Monzur Khan

ট্রেকিং শুরু করার আগ মুহুর্তে রন্ঞ্জন দাস আমাদের কাছে জানতে চাইলো আমাদের সবার ব্যাগ এখানে রেখে যাবো কিনা। কারনটা আমাদের কারোই অজানা ছিল না। চার ঘন্টার পথ। তার ওপর পাহাড়ি পথ। হাম হামে ট্রেকিং করতে যেয়ে ভালোই টের পেয়েছিলাম। কাঁধের ওপর একটা ব্যাগ মানে একটা বোঝা। সেই ভুল কি আবার করি ? রন্ঞ্জন দাসের কথা মোতাবেক ব্যাগগুলো খাবারের দোকানটাতেই রেখে রওনা দেই। তবে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিতে ভুল করি নি। সেগুলোর মধ্যে ওয়ালেট, মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক, পানি ভর্তি ২ লিটারের একটা বোতল, টেস্টি স্যালাইন, ওষুধ, গামছা লুঙ্গি ছিল অন্যতম। ট্রেকিং শুরু করার মিনিট পাঁচকের মধ্যে একটি কল আসল। আমরা ততক্ষনে কিছুদূর এগিয়ে। অপেক্ষা করতেছি রন্ঞ্জনের জন্য। কিছুপর দেখলাম তার সাথে আরও ৩ জন। জানতে পারলাম আর্মি ক্যাম্প থেকে উনাদের ৩ জনকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে বলেছে। ট্রেকিং এর শুরুর কালটা ছিল খুবই আনন্দের। কেওক্রাডং (Keokradong) জয় করতে যাচ্ছি। ছোটবেলায় কত পড়েছি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের নাম কেওক্রাডং । তখন স্রেফ পড়ার খাতিরেই হয়ত পড়া হয়েছিল এটি। কালের পরিক্রমায় সেই ছোট্ট ছেলেটি সেই চুড়ার পথে যাত্রা করছে। এইসব বিষয়গুলোই যেন বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল। নিজের অজান্তেই নিজেকে প্রসংশা করে যাচ্ছিলাম কেন জানি।

পড়ুনঃ ১ম অংশ

ট্রেকিং এর প্রথম এক ঘন্টা মোটামুটি ভালোই ছিল বলা চলে। তেমন একটা ক্লান্তিবোধ করি নি। বড় বড় পাহাড়ের উঁচু নিঁচু পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে হঠাৎ কিছুক্ষন দাড়িয়ে চারপাশের পরিবেশটা দেখতে ভালোই লাগছিল। এই দাড়ানোটার আরেকটা সুবিধা হল একটু বিরতি পাওয়া। যেটি লং ট্রেকিং এর জন্য খুবই কাজের। তবে এর কিছু অসুবিধাও আছে। এমন একটা সময়ে আমরা ট্রেকিং করেছি যেটি শরীরের জন্য মোটেও ভালো না। কিন্তু কি আর করার। সবকিছু তো আর নিজের মতো করে পাওয়া যায় না। গেলেও হয়ত অর্থ এবং সময় দুটোই বাড়বে। ট্রেকিং করছি ঘন্টা দেড়কের মতো হল। এবার আকাঁবাকাঁ খাড়া একটা পথ চলে গিয়েছে ওপরের দিকে। ওদিকে সূর্যি মামার তীর্যকতায় শরীরে পানি শূন্যতা অনুভব করছি। হাতে থাকা ২ লিটার পানির বোতলে ১ প্যাকেট টেস্টি স্যালাইনের পুরোটা ঢেলে দিলাম। তারপর অল্প কিছু পানি পান করি। যখন আমি পানি পান করছিলাম ততক্ষনে বসে ছিলাম। আর চারপাশের পাহাড়ী পরিবেশটা দেখে নিজেকে কিছুটা হালকা করে নিয়েছি। ভাবছি এখানে আসাটা কি খুব দরকার ছিল। শুরু হল আবার ট্রেকিং। ততক্ষনে সঙ্গি সাথীরা অনেকটা দূর এগিয়ে। হঠাৎ করে মনে হল আমি বেশি পিছনে পরে গেলাম না তো। এমনে তো পথ-ঘাট চিনি না। তারপর আবার পাহাড়ী রাস্তা। সাথে আছে অজানা আশংক্ষা। কোনক্রমে যদি পিছিয়ে পড়ি আর সন্ধ্যা হয়ে যায় তাহলে আমি শেষ। এসব উল্টা পাল্টা চিন্তা আসতে না আসতেই বাড়িয়ে দেই হাটার গতি। হঠাৎ করে আমার জন্য রন্ঞ্জনের পিছনে আসাটা কি যে ভালো লেগেছিল তা ভুলবার নয়। সবার প্রতি তার এমন একটি কেয়ার, যা সত্যিই ভালো লাগার মতো। তার ফিরে আসার প্রত্যাবর্তন আমার কাছে দেবদূতের মতো হয়ে ধরা দিল। অথচ সে কিন্তু ট্রেকিং এর শুরু থেকেই সবার থেকে এগিয়ে ছিল। তার ওপর মাঝারি সাইজের ব্যাগের বোঝা কাঁধে নিয়ে। ব্যাগটির মধ্যে আমাদের কয়েকজনের কাপড় চোপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। এতোটা ওজন নিয়ে তার ট্রেকিং করাটা আমার কাছে ওয়ান ম্যান আর্মির মতো মনে হল।

কেওক্রাডং পৌঁছাতে এখনও অর্ধেকটা পথ বাকি। ট্রেকিংটা যাতে বোরিং হয়ে না যায় এজন্য মাঝে মধ্যে সহযাত্রীদের সাথে টুকটুক কথা বলা আর মজা করা অব্যাহত রেখে যাচ্ছি। চলতে চলতে দু একটা ঝিরিপথের দেখা পেয়ে গেলাম। ঝিরিপথের পানি পেয়ে যে যার মতো মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই। আমি তো রীতিমতো ঝর্ণা পানি পান করেই ফেলি। এতো ফ্রেশ আর ঠান্ডা কেউ পান না করলে কেউ জানতে পারবে না কি যে স্বাদ সেই জলের। রন্ঞ্জন দাসের কাছ থেকে জানতে পারলাম এখানে একটা ঝর্ণা আছে। ঝর্ণাটির নাম চিংড়ি ঝর্ণা। সেই ঝর্ণার পানিই এই ঝিরি পথ দিয়ে চলে যাচ্ছে। বর্ষার মৌসুমে আসলে সেই ঝর্ণার দেখা পাওয়া যেত। কিছুক্ষন সেখানে অবস্হান করার পর আমরা আবার ট্রেকিং শুরু করি। প্রস্হান করার পূর্বে খাবারের পানি হিসেবে বোতলে করে ঝর্ণার পানি নিয়ে আসতে কেউ ভুল করি নি। কারন সামনে আরও অনেকটা পথ। ঘাম ঝরার সাথে সাথে শরীরে পানি সরবরাহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ন। তাছাড়া আমাদের পানির স্টকও শেষ হয়ে যাচ্ছিল।

আধা ঘন্টার মতো ট্রেকিং শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম দার্জেলিং পাড়ায়। খুব ছিমছাম এই পাড়াটিতে আদিবাসিদের আনাগোনা দেখে ভালোই লাগল। সবমিলিয়ে হয়ত গোটা বিশেক পরিবারের বসবাস হবে এখানে তাদের। দুই তিনটা দোকানও আছে এখানে। দোকানগুলো তাদের বাড়ির সামনের অংশটুকু নিয়ে করা। সহযাত্রীদের একজন যখন কেওক্রাডাং এর অবস্হানটা দেখিয়ে দিচ্ছিল, তখন মনে মনে ভাবছিলাম যেতে যেতে না আবার রাত হয়ে যায়। সময় তখনও এক ঘন্টার পথের মত বাকি। দার্জেলিং পাড়াটা একটু ভালো করে দেখে নিলাম। আমরা যে সময়টায় পৌঁছায়ছি তখন লোকজনের তেমন কোন আনাগোনা দেখা যাচ্ছিল না। যাই হোক, নিজেদের মধ্যে কিছু ফটো সেশনের কাজ সেরে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম। ঠিক দার্জেলিং পাড়ার শেষ মাথার কাছাকাছি। এখানে একটা দোকানে কিছুক্ষন বিশ্রামের পাশাপাশি হালকা খাবার খেয়ে শরীরের ভিতরে শক্তি সরবরাহের চেষ্টা করি। কিন্তু বেশি কিছু খাওয়ার রেওয়াজ নেই ট্রেকিং এ। তাহলে শরীরের ভার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অলসতা ঘিরে ধরবে।

পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক পরেরদিন সকালে এই দোকানে গরম ভাতের সাথে ব্যাম্বু চিকেন খাবো এই অর্ডার করেই আমরা আবার ট্রেকিং বেড়িয়ে গেলাম। মূলত এটা হচ্ছে ট্রেকিং এর সর্বশেষ ধাপ। কেওক্রাডং এর চূড়ায় পৌছাঁতে আনুমানিক এক ঘন্টার মতো লাগবে। কিন্তু পশ্চিমের সূর্যটা যেন একটু একটু করে হেলে তলিয়ে যাচ্ছে সময়ের অতল গর্ভে। তবে যাই হোক, শেষ ধাপের পথটুকু ছিল এক কথায় অসাধারন। একজন খুদে ফটোগ্রাফারের জন্য এই সময়টুকু ছিল যেন কষ্টের পরে কেষ্ট মেলার মত কিছু একটা। যথারীতি ছবি আর ভিডিওগ্রাফি করতে করতে আবার গেলাম পিছিঁয়ে। বার বারই অজানা আশংকায় ভরকে যাচ্ছি। হঠাৎ-ই পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি আমার যাত্রীদলের অপর তিন নতুন সদস্য আসছে। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত অসমাপ্ত কাজগুলো সেরে নেই। যতই সামনের দিকে ওঠে যাচ্ছিলাম সূর্যটা যেন ততই পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল। ওই তো দেখা যাচ্ছে স্বপ্নের কেওক্রাডং। কিন্তু আবারও একটা চিন্তা এসে পড়ল মাথায়। যেতে যেতে এই সময়গুলো যেন আমার জীবনের সেরা সময়গুলোর মাঝে স্হান করে নিচ্ছিল। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়। গোধুলিলগ্নে জনমানবহীন এমন পাহাড়ী পরিবেশ দেখে কারোই ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করবে না এই কেওক্রাডং থেকে। মনে হচ্ছিল আমার কষ্টের ষোল আনাই স্বার্থক আজ।

হাটার গতিটা আরোও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্ত পা দুটো যেন মোটা হয়ে বসে গেছে একেবারে। কারন এতক্ষনে সূর্য অস্তনিমিত হয়ে গেছে। আর কিছু দেরি হলে আর্মি জওয়ানরা হ্যালিপ্যাডে ওঠতে দিবে না। কিছুক্ষন হল আমরা কেওক্রাডং এর এলাকায় এসে পড়েছি। সুতরাং দুশচিন্তার এখন আর কোন কারনই নাই। অবশেষে হ্যালিপ্যাডের চূড়ায় এসে পড়েছি। কিছুটা আধো আলো আধো অন্ধকারে বিজয় উল্লাসে আমাদের কারোই কোন ব্রুক্ষেপ ছিল। কারন আমরা জানি আমরা কি করেছি। সেটা এখন যেই সময়েই আসুক। এরই মধ্যে আমরা ফটোসেশন আর ভিডিও পর্বের কাজ সেরে ফেলি।

তারপর যথারীতি এখানে অবস্হিত আর্মি ক্যাম্পে আমাদের সকলের পূর্বের ন্যায় নাম ঠিকানা এন্ট্রি করি। এন্ট্রি শেষে আর্মি জওয়ানের বক্তব্যটি ছিল এরকম, “কেওক্রাডংএ আপনাদেরকে স্বাগতম। আপনারা যেখানেই চলাচল করেন না কে, হ্যালিপ্যাডের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে সেটা অতিক্রম করবেন না”। ভাবতেই অবাক লাগে কেওক্রাডাং এর চূঁড়ায় বিশাল আকৃতির একটা জেনারেটর চলে। অথচ বিদ্যুত থাকে না ভেবে মোবাইলের চার্জার আর পাওয়ার ব্যাংকটা নিয়ে এসেছি। এখানেও দার্জেলিং পাড়ার মতো একটা বাড়ি লাগোয়া একটি দোকান আছে। সেখানেই আমরা রাতের খাবারটা সেরে নেই। মেন্যু হিসেবে ছিল ভাত, মুরগীর তরকারি, আলু ভর্তা আর ডাল। খরচ জনপ্রতি ১২০ টাকার মতো। পাহাড়ী খাবারটা অনেকটা স্পাইসি আর লবন ছাড়ার মত লাগল। আমার কাছে তেমন টেস্ট লাগে নি। তারপরও কি আর করার। অল্প কিছু খেয়ে ওঠে গেলাম। খাবারের পানি হিসেবে এখানে পাওয়া যাচ্ছে ঝর্ণার পানি। রন্ঞ্জন বলল, বাড়ির মালিক নাকি দূরের কোন এক ঝর্ণা থেকে পাম্প বসিয়ে পানি আনে। তবে এখানে গোসল কিংবা বাথরুমের অপ্রতুল্যতা আমাদের ভালোই বিপদে ফেলে দিয়েছে। সিরিয়াল করে বাথরুম যাওয়ার প্রতিযোগিতার সাথে আমি বরাবরের মতোই বেমানান।

এখানে খুব ঠান্ডা। পড়নের শীতবস্ত্রটা যেন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছিল না হিম শীতল পরিবেশটাকে । কয়েকজন মিলে কেওক্রাডাং চূঁড়ায় গালগল্প করার জন্য একটা স্হানে বসে আছি। পাশে একটা মেয়েদলের গানের পালা থেকে কিছুক্ষন পরপর এক একটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা অসমাপ্ত গান উড়ে আসছে। রাত ১০ টা বাজবে হয়ত। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে সময়টা দেখতে ইচ্ছে করছিল না কেন জানি। কিছুক্ষন আগে বউয়ের সাথে কথা হল। ওদেরকে খুব মিস করছি। আকাশ জুড়ে ঝলঝলে তারা নক্ষত্র। দূরের আলোকিত দার্জেলিং পাড়াটা দেখে এখন আর কোন বুঝার উপায় নেই এটি দুর্গম পাহাড়ের খাঁজে ছোট্র একটি গ্রাম। সকালের রক্তিম সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় কেটে যাচ্ছিল মুহূর্তগুলো। হয়তবা আর আসা হবে না এখানটায়, সেই ছোট্ট বেলার বইয়ের মাঝে, সর্বোচ্চ চূঁড়া কেওক্রাডাং এ।


শেয়ার করুন সবার সাথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!