দামতুয়া ঝর্না পরিচিতি
দুর্গম পাহাড়ির মাঝে এক ঝর্ণা, নাম দামতুয়া। অবস্থান বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায়। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় বলেই হয়তো ঝর্ণাটির রয়েছে বিশেষ কদর। পাথরের বুক বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার জলরাশি মুহূর্তেই প্রাণ সঞ্চার করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসা ক্লান্ত পর্যটকদের মাঝে। স্থানটির স্নিগ্ধ প্রকৃতি মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে নেয় সকলকে। এই অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে অনেকেই দামতুয়া ঝর্ণাকে দেশের অন্যতম সুন্দর ঝর্ণা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ঝর্ণাটি পর্যন্ত পৌঁছানোর পথটিও বেশ রোমাঞ্চকর।
যারা ট্রেকিং করতে পছন্দ করেন তাদের সবুজে ঘেরা পাহাড়ি এই রাস্তা ভালো লাগতে বাধ্য। ট্রেকিং এর সময় উঁচু পাহাড় থেকে দৃষ্টিগোচর চারিদিকের দৃশ্য সত্যিই অপরূপ। এই যাত্রাপথেই চোখে পড়ে আদিবাসীদের গ্রাম, সেখানে তাদের জীবনযাত্রার চিত্র। তবে গন্তব্যের এই রাস্তাটি বেশ লম্বা এবং দুর্গম। তাই অবশ্যই সক্ষমতা বিবেচনা করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
দামতুয়া জলপ্রপাতের নামকরণ
দামতুয়া ঝর্ণাটি বেশ কিছু নামে পরিচিত। যার মধ্যে ডামতুয়া, লামোনই, ওয়াজ্ঞাপারাগ এবং তুক অ উল্লেখযোগ্য। এসব নামের রয়েছে নিজস্ব অর্থবহতা। ডামতুয়া অর্থ খাড়া দেয়াল বা প্রাচীর। লামোনই অর্থ চাঁদের আলো, যা মূলত চাঁদের আলোয় সৃষ্ট ঝর্ণাটির ভিন্নধর্মী সৌন্দর্যকে নির্দেশ করে। ওয়াজ্ঞাপারাগ বলতে উঁচু স্থান থেকে প্রবাহিত পানিকে বোঝায়। অন্যদিকে স্থানীয় মুরং ভাষায় তুক অ এর অর্থ হলো ব্যাঙ ঝিরি।
দামতুয়া ঝর্ণা কোথায় অবস্থিত
দামতুয়া ঝর্ণাটির অবস্থান বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার মুরং নামক এলাকায়।
যাওয়ার উপযুক্ত সময়
যে কোন ঝর্ণার মত দামতুয়া ঝর্ণারও আসল রূপ ফুটে ওঠে বর্ষাকালে। কারণ বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এ সময় পানির প্রবাহ বেশি হয়ে থাকে। তাই বর্ষা বা বর্ষা পরবর্তী সময় অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এখানে আসার উপযুক্ত সময়। তবে অতিবৃষ্টি হলে ঝর্ণা পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠায় অনেক সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। যাওয়াটা নিরাপদও নয়। তাই আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে আলীকদম
দামতুয়া ঝর্ণায় যাওয়ার প্রথম ধাপ হলো আলীকদম পৌঁছানো। সড়কপথে দুইভাবে আলীকদম যাওয়া সুবিধাজনক।
১. সবচেয়ে সহজ উপায় হলো রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদম এর বাসে যাত্রা করা। এই রুটে চলাচলকারী বাস অপারেটরদের মধ্যে শ্যামলী পরিবহন ও হানিফ পরিবহন উল্লেখযোগ্য। বাস ভাড়া ১০০০
টাকার কাছাকাছি (নন-এসি)। ঢাকার গাবতলী এবং ফকিরাপুল বাস স্ট্যান্ড এসব বাস চলাচল করে। আলীকদম যেতে সময় লাগে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। অর্থাৎ রাতের বাসে রওয়ানা দিলে ভোরের মধ্যেই আলীকদম চলে যাওয়া সম্ভব।
২. দ্বিতীয় পন্থাটি হলো কক্সবাজারগামী বাসে চকরিয়া হয়ে আলীকদম যাওয়া। শ্রেণিভেদে ভাড়া ৮৫০ টাকা থেকে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আপনাকে চকরিয়া বাজারে নামতে হবে। এরপর চকরিয়া নতুন বাস স্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে করে আলীকদমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব বাস চলাচল করে। বাসের ভাড়া পড়বে ৭০ টাকার কাছাকাছি। এছাড়া চান্দের গাড়িতে করেও চকরিয়া থেকে আলীকদম যেতে পারবেন। জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৭০ টাকা।
আলীকদম থেকে দামতুয়া ঝর্ণা
পৌঁছে গেলেন আলীকদম, এরপর? এবার আপনাকে চলে যেতে হবে আলীকদমের পানবাজারে। সেখান থেকে রওয়ানা দিতে হবে “১৭ কিলোমিটার” পয়েন্টের আদুপাড়ার উদ্দেশ্যে। আলীকদম এর পানবাজার থেকে আদুপাড়ায় যাবার জন্য মোটরসাইকেল পেয়ে যাবেন, ফিরতি যাত্রাও হবে সেই একই মোটরসাইকেলে। একটি মোটরসাইকেলে দুইজন যেতে পারবেন, দুইজনের আসা-যাওয়া মিলিয়ে ভাড়া গুনতে হবে ৮০০ টাকা। গ্রুপ নিয়ে গেলে চান্দের গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন। রিজার্ভ করার ক্ষেত্রে দামাদামি করে নিতে হবে।
আদুপাড়া যাওয়ার পথে রয়েছে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, সেখানে আপনাকে ফোন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। ট্রেকিং শেষে বিকাল ৫টার মধ্যে এই ক্যাম্পে ফিরে হাজিরা জানাতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই এই নিয়ম করা হয়েছে। তাই সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখার অনুরোধ রইলো। মূলত এই আদুপাড়া থেকেই শুরু হবে রোমাঞ্চকর ট্রেকিং। দামতুয়া ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে আপনাকে সাথে বাধ্যতামূলক একজন গাইড নিতে হবে। গাইডে ফি হিসাবে প্রদান করতে হবে ১০০০ টাকা। আদুপাড়া থেকে দামতুয়া ঝর্ণা ঘুরে আসতে সাধারণত ৬ ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ের প্রয়োজন পড়ে। আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রায় ১২-১৩ কিলোমিটারের পাহাড়ি এই রাস্তায় বোনাস হিসাবে দেখা পাবেন তুক অ ঝিরি ও ওয়াংপা।
ঝর্ণার মত কিছু সুন্দর জলপ্রপাতের। তবে কি কি দেখতে চান গাইডের সাথে সে বিষয়ে আগে থেকেই আলোচনা করে নেওয়া ভালো।
কোথায় থাকবেন
দামতুয়া ঝর্ণার সন্নিকটে রাত্রিযাপনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ সেনাবাহিনী সাধারণত আশেপাশের গ্রামগুলোতে ক্যাম্পিং এর অনুমতি প্রদান করে না। তাই থাকার জন্য কমপক্ষে আলীকদম পর্যন্ত ফিরতে
হবে। সেখানে সাধারণ মানের কিছু আবাসিক হোটেল পেয়ে যাবেন। নিচে আপনাদের সুবিধার্থে হোটেলের নম্বর এবং ঠিকানা দেওয়া হলো
দ্য দামতুয়া ইন
আলীকদম উপজেলা রোড, আলীকদম
ফোনঃ +৮৮ ০১৭৪৮-৯১২১২৭
এছাড়া জেলা পরিষদের ডাক বাংলো-তে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
কোথায় খাবেন
আলীকদমের পানবাজারে খাবার কয়েকটি হোটেল আছে। বাকি পথে তেমন কোনো হোটেল না থাকায় সেখান থেকেই খাবারদাবার সেরে নিতে হবে। দুপুরের খাবার হিসেবে সাথে শুকনো খাবার এবং পানি নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি খাবার স্যালাইনও সাথে রাখা ভালো। এছাড়া আদুপাড়ায় টং দোকান থেকে হাল্কা কিছু খাবার গ্রহণ করতে পারবেন।
দামতুয়া ভ্রমণ খরচ
ভ্রমণ খরচ নানা বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। তাই সবার ক্ষেত্রে একই বাজেট প্রযোজ্য নয়। তবুও আপনাদের ধারণা নেওয়ার জন্য নিম্নে জনপ্রতি খরচ সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করা হলো –
ঢাকা থেকে আলীকদম (বাস ভাড়া) – ১,০০০ টাকা
আলীকদম বাজার থেকে পান বাজার (অটো ভাড়া) – ৪০ টাকা
পান বাজার থেকে আদুপাড়া এবং ফিরতি যাত্রা (মোটরসাইকেল ভাড়া) – ৮০০ টাকা (২ জনের আসন)
গাইড ফি – ১,০০০ টাকা
খাবার ও অন্যান্য খরচ – ৫০০ টাকা
মোট – ৩,৩৪০ টাকা
তবে গ্রুপ নিয়ে গেলে জনপ্রতি খরচ অনেকটাই হ্রাস পায়।