নিকলী হাওর ভ্রমণ
বর্তমান সময়ে এদেশে যতগুলো হাওর বাওর আছে, তার মধ্যে নিকলী হাওরে (Nikli Haor) ভ্রমন করাটা দেশি বিদেশী পর্যটকদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষনীয় হয়ে দাড়িয়েছে। চারদিকে অথৈ জল, সেই জলের মাঝে হাওর অন্ঞ্চলের মানুষের জনজীবন বিশেষ করে বর্ষার মৌষুমে নৌকায় করে তাদের যাতায়াত, মাঝিদের মাছ ধরার দৃশ্য, হাওরের মাছে দুপুরের খাবারের আয়োজন, কোথাও জেগে ওঠা চরে জলারবনের মাঝে যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চান, তাহলে নিকলী হাওর ভ্রমন হতে পারে আপনার কাছে আর্দশ একটা স্হান। আর যারা একদিনের ট্যুর পছন্দ করেন তাদের জন্য বেস্ট একটা অপশন হতে পারে নিকলী হাওরে ভ্রমন।
নিকলীর অবস্হান কিশোরগন্ঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায়। সদর থেকে প্রায় ২৫কিঃমিঃ দূরে অবস্হিত এই হাওর। বর্ষাকালে ২১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপেজলার বেশির ভাগ অন্ঞ্চলে পানিতে নিম্মজিত থাকে। তাই, বর্ষার মৌসুমে চলাচলের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে নৌকা বা ট্রলার ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
নিকলী হাওরে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
যদি হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাহলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে বর্ষাকালের জন্য।
সাধারনত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে গেলেই দেখা পাবেন দিগন্ত বিস্তৃত এই হাওরটিকে। তবে, বছরের অন্য সময়গুলোতে আসলে পাবেন ভিন্ন এক রূপ।
নিকলীতে যাওয়ার উপায়
দেশের যে কোন প্রান্ত থেকেই আসা যায় নিকলীতে। বাসে বা ট্রেনে আসার উভয় ব্যবস্হায় আছে। তবে, যারা ঢাকা, কিশোরগন্ঞ্জ বা তার আশে পাশের জেলায় যেমন নরসিংদী, বাহ্মনবাড়িয়াতে থাকেন তারা একদিনেই ঘুরে আসতে পারেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে কিভাবে আসবেন
ভ্রমণের জন্য ট্রেনে যাতায়াত হচ্ছে সবচেয়ে আরামদায়ক এবং সময় সাশ্রয়ী। তাছাড়া ভ্রমণ ব্যয়ও কমে যায় এতে। দিনে গিয়ে আবার দিনেই ঘুরে আসতে চাইলে এগার সিন্ধুর প্রভাতি ট্রেনটি ধরতে হবে। ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে সকাল ৭ঃ১৫ তে ছেড়ে আসে এটি। ট্রেনটি সপ্তাহের বুধবার ছাড়া বাকি ৬ দিনেই চলাচল করে। আসন ভেদে ভাড়া ১২৫ টাকা থেকে ৫১৮ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। পথ্যিমধ্যে নরসিংদী এবং ভৈরবে যাত্রা বিরতিতে অবস্হান করবে এটি। তাই, এই দুইটি স্টেশনের আশেপাশে অবস্হানরত যে কেউ এটিতে করে নিকলী থেকে ঘুরে আসতে পারবেন।
এরপর কিশোরগন্ঞ্জের গচিহাটা রেল স্টেশনে নেমে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে বা ভাড়াতে চলে যান নিকলী বেড়িবাঁধের শেষ প্রান্তে। সাধারনত রিজার্ভ ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হয়ে থাকে। কেউ চাইলে ভাড়াতেও যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৫০-৬০ টাকা।
গচিহাটা রেল স্টেশনে যখন নামবেন তখন হয়ত ঘড়ির কাটা সকাল ১১ কিংবা ১১ঃ১৫ গিয়ে ঠেকবে। নিকলী হাওর ভ্রমণে পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু সময়মত করতে পারলে আপনার ভ্রমণ হবে সফল। গচিহাটা রেল স্টেশন থেকে নিকলী বেড়িবাধেঁর কাছে পৌঁছাতে সময় লাগবে আরও ৪০-৫০ মিনিট। অর্থাৎ আপনি যখন নিকলী বেড়িবাধেঁ এসে পৌঁছাবেন তখন বাজবে দুপুর ১২ টা। ফেরার পথে চাইলেও ট্রেনে ফিরতে পারবেন। সন্ধ্যা ৬ঃ৪০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এগারসিন্ধুর গোধূলি।
ঢাকা থেকে বাসে কিভাবে আসবেন
ঢাকা থেকে বাসে যেতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে আসতে হবে আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে। এখান থেকে যাতায়াত পরিবহনের বাস ছেড়ে যায় প্রতি ২০ মিনিট অন্তর অন্তর। ভাড়া ২৫০ টাকা। তারপর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি বাস স্টপেজে নেমে পড়তে হবে। কোন জ্যাম না থাকলে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা লেগে যাবে কটিয়াদি পর্যন্ত আসতে। যাতায়াত পরিবহনের বাস ছাড়াও যেমন অনন্যা পরিবহনের বাসগুলো ছেড়ে যায় গোলাপবাগ, শনির আখড়া চিটাগাং রোড থেকে। কটিয়াদি থেকে নিকলি হাওরে যেতে গ্রুপ মেম্বার হিসেবে সিএনজি বা লেগুনা ভাড়া করতে পারেন। এইক্ষেত্রে সিএনজি রিজার্ভ নিলে ভাড়া পড়বে ৩০০-৪০০ টাকা। লেগুনাতে গেলে ভাড়া পড়বে ৫০০-৭০০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা থেকে দেড় ঘণ্টা।
কিশোরগঞ্জ সদর থেকে কিভাবে আসবেন
কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে নিকলী যেতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে আসতে হবে কিশোরগঞ্জ রেল ষ্টেশনে। এখানের সিএনজি ষ্টেশন থেকে নিকলীর উদ্দেশ্যে একটি সিএনজি রিজার্ভ করে বা ভাড়াতে চলে যান। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা
ভৈরব থেকে কিভাবে আসবেন
চট্টগ্রাম, সিলেট বা ভৈরবের আশেপাশের জেলা থেকে বাসে বা ট্রেনে নিকলী আসতে চাইলে আপনাকে নামতে হবে ভৈরব বাস স্ট্যান্ডে অথবা ভৈরব রেল ষ্টেশনে। বাস স্টান্ড থেকে সিএনজি ভাড়া নিয়েও নিকলী যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। ভৈরব থেকে নিকলী যেতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টা।
খাবেন কোথায়
নিকলী বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কিছু খাবার হোটেল পাবেন। যেখানে খুব কম খরচেই দুপুরের খাবার খেতে পারবেন। ১২০ টাকা থেকে প্যাকেজ অনুযায়ী বিভিন্ন রেটের মধ্যে খাবার পেয়ে যাবেন। খাবারের আইটেমের মধ্যে মাছ রাখবেন। কারন, হাওরের মাছ খাওয়ার এমন সুযোগ আর কোথাও পাবেন না।
হাওরে ঘুরবেন কিভাবে
হাওরে ঘুরে বেড়ানোর পূর্বেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। কারন নৌকায় করে ২-৩ ঘন্টা ঘুরাঘুরি করতে করতে অনেক বেলা হয়ে যাবে। তাছাড়া হাওরের মাঝে খাবারের ব্যবস্থাও পাবেন না। এরপর দামাদামি করে একটা ভালো মানের নৌকা ভাড়া করুন । এইক্ষেত্রে নৌকার মাঝি বা দালালরা বেশি দাম চেয়ে থাকবে।
বুদ্ধিমানের কাজ হবে যদি বলতে পারেন শুধু ছাতির চরে যাবো, কিছুক্ষণ থাকার পর চলে আসবো। সব মিলিয়ে দুই থেকে আড়াই ঘন্টার মত লাগবে। দালাল বা মাঝিরা ২-৩ টা স্পটের নাম বলে বেশি ভাড়া নিতে চায়। নৌকার সাইজের ওপর ভিত্তি করে নৌকার ভাড়া নির্ধারিত হয়। সাধারনত মাঝারি সাইজের নৌকাগুলো ১২০০-১৫০০ টাকা এবং বড় সাইজের নৌকাগুলো ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা ভাড়া হয়ে থাকে।
- আরও পড়ুন | টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ গাইড
মুলত নিকলীতে দেখার মত ছাতির চর গ্রামটাই আছে। যেখানে পাবেন একটি জলারবন। এখানে কিছুক্ষণ থেকে গোসল করে নিতে পারেন। তাছাড়া উপভোগ করতে পারবেন সুনামগঞ্জের মত পানিতে অর্ধ নিম্মজিত হিজল গাছের দৃশ্য। যা সত্যিই চোখে পড়ার মত দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মাঝে প্রকৃতির এ অপরূপ দৃশ্যে নিজেকে হারিয়ে নিতে পারেন কিছু সময়ের জন্য। হাওরে ঘুরাঘুরি শেষে বেড়িবাঁধ থেকে সিএনজি ভাড়া করে চলে আসুন কিশোরগঞ্জ সদরে। এখানে একটি ঐতিহাসিক মসজিদ আছে, যা পাগলা মসজিদ নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জ শহরটি দেখার পাশাপাশি এই মসজিদটিও দেখে আসতে পারেন। সন্ধার পরে নানান রকম আলোকসজ্জায় এক রূপ পাওয়া যায় মসজিদটিতে। সিএনজি বা লেগুনা ড্রাইভারকে আগেই বলে রাখুন সে যেন পাগলা মসজিদ ঘুরিয়ে ঢাকাগামী বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে যায় সন্ধ্যা ৭ টার পূর্বে। কারন এরপরে ঢাকার উদ্দেশ্যে আর কোন বাস ছেড়ে যাবে না। নিকলি হাওর থেকে কিশোরগঞ্জ সদরে আসতে সময় লাগবে ১ থেকে দেড় ঘন্টা। কেউ চাইলে এগার সিন্ধুর গোধূলি ট্রেনটি ধরেও ঢাকায় চলে আসতে পারেন। এটি ৬:৪০ মিনিটে ছেড়ে আসে কিশোরগঞ্জ রেল ষ্টেশন থেকে।
নিকলি হাওরের ভিডিও দেখুনঃ নিকলি হাওর
থাকবেন কোথায়
নিকলিতে থাকার মত ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। কেউ চাইলে কিশোরগঞ্জ সদরে এসে কোন হোটেলে থাকতে পারেন।
আশেপাশের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান
- মিঠামইন হাওর
- অষ্টগ্রাম হাওর
- ইটনা মিঠামইন অষ্টগ্রাম সড়ক
ভ্রমণ সতর্কতা
- সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট সাথে করে নিয়ে যাবেন।
- নৌকার ওপর লাফালাফি করবেন না।
- সন্ধ্যার পর নৌকায় ভ্রমণ করবেন না।
আরও পড়ুন
ছবি ও লেখকঃ Monzur Khan