রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট
সিলেট জেলায় অবস্থিত রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট ভ্রমণপিয়াসুদের অন্যতম পছন্দের এক জায়গার নাম। তার পেছনের কারণটাও বেশ স্পষ্ট, রাতারগুলের নিজস্ব ভিন্নধর্মী সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানে আসার বিকল্প নেই। চারদিকে পানি এবং সবুজের সমারোহ প্রশান্তির এক আবেশে জড়িয়ে নেয় স্থানটিতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের। পানিতে অর্ধ নিমজ্জিত গাছগুলোর চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে কখনো বেরিয়ে আসে সূর্যের রশ্মি আবার কখনো বা ঝড়ে পড়ে বর্ষার জল। এসব গাছ দেখলে মনে হয় সোজা পানির বুক থেকে উঠে এসেছে এর শাখা-প্রশাখা। নানা সময়ে গাছগুলোতে দেখা মেলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। এখানের ওয়াচ টাওয়ার থেকে দৃষ্টিগোচর হয় মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য। নৌকায় বসে পানিতে বৈঠার সৃষ্ট শ্রুতিমধুর শব্দ শুনলে মনের মাঝে তৈরি হয় ভিন্নরকম এক ভালোলাগার।
রাতারগুল পরিচিতি
রাতারগুলের প্রধান পরিচয় হলো এটি বাংলাদেশের একমাত্র জলার বন বা সোয়াম্প ফরেস্ট। সমগ্র বিশ্বের ২২টি মিঠাপানির জলাবনের মধ্যে এটি একটি। রাতারগুল ‘সিলেটের সুন্দরবন’ এবং ‘বাংলার আমাজন’ নামেও পরিচিত। এই বনের আয়তন ৩,৩২৫ একরের কাছাকাছি। এখানকার বনাঞ্চলের ৫০৪ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য। বর্ষার সময় এখানে পাবদা, টেংরা, রিটা সহ বিভিন্ন মাছ পাওয়া যায়। বছরে ৪ থেকে ৫ মাস এই বন পানিতে তলিয়ে থাকে। রাতারগুলের বনাঞ্চলজুড়ে রয়েছে হিজল, বেত, কদম সহ প্রায় ২৫ প্রজাতির গাছপালা, যার সবগুলোই জলসহিষ্ণু। যতদূর জানা যায় সিলেটের স্থানীয় ভাষায় রাতা নামক এক গাছের নাম থেকেই এই বনের নামকরণ।
রাতারগুল কোথায়
রাতারগুলের অবস্থান সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে। বনটি গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত। এই বনের দক্ষিণে আছে শিমুল বিল এবং নেওয়া বিল নামক দুটি হাওর। সিলেট শহর থেকে রাতারগুলের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টার কাছাকাছি।
রাতারগুল যাওয়ার উপায়
রাতারগুল যেতে চাইলে সর্বপ্রথম পৌঁছাতে হবে সিলেট জেলায়। তারপর সেখান থেকে চূড়ান্ত গন্তব্য রাতারগুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে।
ঢাকা থেকে সিলেট
সড়কপথঃ
সড়কপথে ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ এবং ফকিরাপুল থেকে হানিফ, এনা, ইউনিক, গ্রীন লাইন সহ বেশ কয়েকটি অপারেটরের বাস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫৫০ থেকে ১১০০ টাকা। লোকাল অপারেটরদের মধ্যে সিলকম, মামুন পরিবহন অন্যতম। এসব বাসে ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকার কাছাকাছি। একদিনের ভ্রমণে যেতে চাইলে রাত ১০টার পরের বাসে রওয়ানা দেওয়া ভালো। সিলেটের হুমায়ুন চত্বরে এই বাসযাত্রার সমাপ্তি ঘটে।
যোগাযোগ
১৬৫৫৭ (গ্রীন লাইন)
০১৯৪৪-৮০০২০০ (এনা)
রেলপথঃ
পারাবত, জয়ন্তিকা, কালনী এবং উপবন এক্সপ্রেস নামক ট্রেনগুলো সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে ঢাকার কমলাপুর থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে পারাবত এক্সপ্রেস মঙ্গলবার, উপবন এক্সপ্রেস বুধবার এবং কালনী এক্সপ্রেস শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহের ৬ দিন চলাচল করে।
অন্যদিকে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস প্রতিদিনই চলাচল করে থাকে। পারাবত এক্সপ্রেস সকাল ৬টা ২০ মিনিট, উপবন এক্সপ্রেস রাত ৮টা ৩০ মিনিট, কালনী এক্সপ্রেস দুপুর ৩টা এবং জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৩০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। বাজেট ট্যুরের ক্ষেত্রে ট্রেনের সুলভ শ্রেণী যাত্রার ভালো একটি মাধ্যম। একদিনের সিলেট ভ্রমণের ক্ষেত্রে রাতের উপবন এক্সপ্রেসে যাত্রা করা তুলনামূলক সুবিধাজনক।
যোগাযোগ
০০৮৮-০২-৯৩৫৮৬৩৪ (কমলাপুর রেল স্টেশন)
আকাশঃ
বিমান বাংলাদেশ, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ইত্যাদি অপারেটরের প্লেন ঢাকা – সিলেট রুটে চলাচল করে। ভাড়া শুরু ৩২০০ টাকা থেকে।
যোগাযোগ
১৩৬০৩ (নভোএয়ার)
০১৯৯০৯৯৭৯৯৭ (বিমান বাংলাদেশ)
সিলেট থেকে রাতারগুল
একটি পন্থা হলো সিলেটের অম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজিতে করে গোয়াইনঘাট যাওয়া। শেয়ারে গেলে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০০ টাকা এবং রিজার্ভ নিতে খরচ হবে প্রায় ৫০০ টাকা। পরিবার নিয়ে গেলে ফেরার সুবিধার দিকটি বিবেচনায় রিজার্ভ নেওয়াই ভালো। সেখান থেকে চৌরঙ্গি ঘাট বা মাঝের ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে যেতে হবে রাতারগুল। একটি নৌকায় ৪-৫ জন যাওয়া সম্ভব। আসা যাওয়া মিলিয়ে ভাড়া গুনতে হবে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
এছাড়া আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মোটরঘাট গিয়ে সেখান থেকে সরাসরি নৌকায় করে রাতারগুল যাওয়া যায়। সিএনজি ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং নৌকা ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ৩০০ টাকার কাছাকাছি। অর্থ এবং সময় সাশ্রয়ের জন্য এই পথটি বেশ ভালো।
আরেকটি উপায় হলো সিলেট থেকে জাফলংগামী গাড়িতে করে সারীঘাট হয়ে গোয়াইনঘাট গিয়ে সেখান থেকে প্রথম পন্থায় উল্লেখিত উপায়ে রাতারগুল যাওয়া।
সিএনজি বা নৌকা ভাড়ার ক্ষেত্রে দামাদামি করে নেওয়ার পরামর্শ থাকলো।
একদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা
রাতারগুল ঘুরে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টাই যথেষ্ট। তাই ডে ট্যুরে রাতারগুল ভ্রমণে গেলে এর পাশাপাশি ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরও সহজেই ঘুরে দেখা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সিলেট শহর থেকে সকালের নাস্তা শেষ করে সাদাপাথর এবং সেখান থেকে রাতারগুল গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আবার সিলেট শহরে ফিরে আসতে হবে। যাওয়ার পথে মালনীছড়া চা বাগানেও অনেকে ঢু মেরে আসেন। স্পটগুলোয় যেতে সারাদিনের জন্য সিএনজি রিজার্ভ করতে খরচ হবে ১২০০-১৫০০ টাকা এবং লেগুনা রিজার্ভ করতে গুণতে হবে ২২০০-২৫০০ টাকা। একা ভ্রমণে গেলে বাস এবং ইজি বাইকে করে ভেঙে ভেঙে এই পথ পাড়ি দিতে হবে।
রাতারগুল যাওয়ার উপযুক্ত সময়
বছরের বিভিন্ন সময়ে রাতারগুল বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষার সময় রাতারগুলের স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়ায় সবার মাঝে। বৃষ্টির পানি বনের সর্বত্র এনে দেয় সজীবতার ছোঁয়া। অন্যদিকে শীতকালে কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির মাঝে আবির্ভাব ঘটে অতিথি পাখিদের। পানির স্তর নেমে গিয়ে ছোট নালাগুলো পরিণত হয় হাঁটা পথে, যা দিয়ে চাইলে পায়ে হেঁটেই বনটি ঘুরে দেখা সম্ভব। তবে বর্ষাকাল যাওয়ার উপযুক্ত সময় হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ সেসময়ই রাতারগুল ভ্রমণ করেন। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বর্ষার শেষ দিকে (জুলাই থেকে অক্টোবর) রাতারগুল যাওয়া উত্তম। এই সময়টাতে সাধারণত পানির উচ্চতা খুব বেশি বা কম না থাকায় সহজেই নৌকায় চারিদিক ঘুরে দেখা যায়।
রাতারগুলে প্রবেশ এবং অন্যান্য ফি
২০২০ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় রাতারগুলে প্রবেশ সহ বেশ কিছু ফি নির্ধারণ করে। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো –
প্রবেশ ফি
প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৫০ টাকা, অপ্রাপ্তবয়স্ক (১২ বছরের নিচে) এবং পরিচয়পত্রধারী শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ টাকা এবং বিদেশী পর্যটকদের জন্য প্রবেশ ফি ৫০০ টাকা।
ফিল্মিং ফি
উক্ত বনে প্রফেশনাল গ্রেড শুটিং করতে প্রতিদিন গুণতে হবে ১০ হাজার টাকা। তবে সাধারণ ব্যবহারের জন্য ছবি, ভিডিও শুট করতে কোনো ফি প্রদান করতে হবে না।
পার্কিং ফিঃ
মোটরসাইকেল/সিএনজি এর জন্য ২৫ টাকা, প্রাইভেট কার/জিপ/মাইক্রোবাস ১০০ টাকা এবং বাস পার্কিং ফি ২০০ টাকা।
রাতারগুলে কায়াক এবং গাইড ভাড়া
জলার বন রাতারগুল ঘুরে দেখার জন্য কায়াক দারুণ একটি মাধ্যম। ইচ্ছেমত ঘোরার স্বাধীনতার পাশাপাশি রোমাঞ্চকর একটি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য কায়াকিং এর বিকল্প নেই। বিশেষত বন্ধুদের সাথে গেলে কায়াকিং ভ্রমণের আনন্দকে একধাপ বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। চৌরঙ্গি ঘাট থেকে কায়াক ভাড়া নেওয়া যায়।
এক ঘণ্টার জন্য জনপ্রতি খরচ পড়বে ১৫০ টাকা। একটি কায়াকে ৩ জন ওঠা সম্ভব। তবে সাঁতার না জানলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরিধান করতে হবে। প্রথমবারের মত ঘুরতে গেলে সাথে গাইড নেওয়া ভালো। ঘণ্টাপ্রতি গাইডকে দিতে হবে ১৫০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
রাতারগুলে থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ঘোরাঘুরি শেষে ফিরে আসতে হবে সিলেট শহরে। সিলেটে ভালো মানের বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে।
কোথায় খাবেন
রাতারগুলে খাবার ভালো হোটেল না থাকায় সিলেট শহর থেকেই খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়া উত্তম। সিলেটের রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে পানসী রেস্টুরেন্ট, পালকি রেস্টুরেন্ট এবং পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট বেশ জনপ্রিয়। সকালের নাস্তার জন্য পরোটা, ডিম ভাজি, ডাল, সবজি ভাজি এবং দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য ভাত, হরেক রকমের ভর্তা, সবজি, মাছ এবং মাংস পাওয়া যায় এসব রেস্তোরাঁয়।
ভ্রমণে সতর্কতা
রাতারগুল ভ্রমণে গেলে সাপ এবং জোঁকের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রাতারগুলের ওয়াচ টাওয়ারটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় সেটিতে না ওঠাই উত্তম।
সিলেটের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
হাতে একটু সময় নিয়ে গেলে রাতারগুলের পাশাপাশি সিলেটের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে দেখা সম্ভব। এর মধ্যে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার, জাফলং, লালাখাল, বিছনাকান্দি অন্যতম।
ছবিটি তুলেছেনঃ Monzur Khan