লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি
ডিসেম্বর আর জানুয়ারি জুড়েই শীত মহাশয় নিজের ক্ষমতার জানান দিতে থাকে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী মানুষ এই কনকনে শীত উপেক্ষা করে দূর-দূরান্তে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু অনেকেই সময়ের অভাবে অবসাদ কাটাতে যেতে চান ঢাকার আশে পাশেই। ঢাকার খুব কাছেই রয়েছে ইতিহাসে মোড়া লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি (Lokkhon Saha Jamidar Bari) । এটি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাংগা বাজারের জয়নগর এলাকাতে অবস্থিত। কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন আর খরচ কত এই বিষয়েই আজকের সমাচার।
কারূকাজে ঘেরা লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি
মোগল সময়ের কারুকাজ আর জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য দুইয়ের মেলবন্ধনের আরেক নাম হচ্ছে লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি। ২৪ কক্ষ বিশিষ্ট দোতালা এই বাড়ির সৌন্দর্য সত্যিই চোখে লাগার মত। মূল দোতালা বাড়ির পাশেই রয়েছে ছোট আর একটি অপূর্ব ঘর। তার ঠিক পাশেই অর্ধ নির্মিত আর একটি পুরাতন বাড়ি। প্রতিটি বাড়িই কারূকাজ মণ্ডিত কিন্তু মূল বাড়ির কারুকাজ আজও অবাক করে দেয়। বাগান, সান বাধানো পুকুর ঘাট পূজোর মঠ সব নিয়ে যায় ইতিহাসের সেই জমিদারদের সময়ে। পুরো বাড়ি আর বাগান ঘিরে রেরেছে প্রাচিন উঁচু প্রাচীর। মূল্যবান কষ্টিপাথর দিয়ে সান বাঁধানো পুকুর ঘাটের পাশেই ১ টি পূজোর মঠ। জানা যাই আগে ৪ টি থাকলেও ৩ টি মঠ অবশ্য মাটির সাথে মিশে গেছে।
ইতিহাসের পাতায়
ইতিহাস অথবা মোগল সাম্রাজ্যর সময়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে চাইলে যেতে হবে লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি। দোতালা ভবনটির প্রতি পরোতে পরোতে রয়েছে অতীতের ঐতিহ্য। কবে নাগাদ জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেই বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
জমিদারের অধীনস্থ সাব-জমিদার লক্ষণ যাহা নির্মাণ করেছিলেন এই বাড়িটি। কিন্তু তাদের কখনো ব্রিটিশদের খাজনা দিতে হয়নি কারণ সে সময় এলাকাটি ছিল ভারত উপমহাদেশের একমাত্র ওয়াকফভুক্ত অঞ্চল। আর সে সময়ের আইন অনুযায়ী ওয়াকাফভুক্ত অঞ্চলকে খাজনা দিতে হতো না। লক্ষণ সাহার তিন ছেলের ছোট ছেলে বঙ্কু সাহা ভারত ভাগের সময় ভারতে চলে যান। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগেই ভারতে যান বড় ছেলে নিকুঞ্জ সাহা। বাকি থেকে যান শুধু পেরিমোহন সাহা।
লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়িটি জমিদার বংশের প্রতীক হলেও সবাই বর্তমানে এটাকে উকিলবাড়ি বলেই জানে। পেরিমোহন সাহার ছেলে বৌদ্ধ নারায়ন সাহা এই অপূর্ব সুন্দর বাড়িটি বিক্রি করে দেন আহম্মদ আলী উকিলের কাছে। আর এরপর থেকেই জমিদারের বংশের প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও এই বাড়ি পরিচিত হতে থাকে উকিলবাড়ি নামে। বিক্রি করে দেয়ার পরে উকিল সাহেব তার স্ত্রীর নাম অনুসারে বাড়ির নাম রাখেন জামিনা মহল।
জমিদার বাড়িটির ভিডিও দেখুনঃ লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি
যাবেন যেভাবে
আপনি আপনার সুবিধা মত রুট দিয়ে যেতে পারেন লক্ষন সাহার জমিদার বাড়ি। বাস কিংবা প্রাইভেট কার দুইভাবেই যেতে পারেন। অনেকেই মোটরসাইকেল নিয়ে যান।
গুলিস্থান – নরসিংদী
আপনি যদি গুলিস্থান থেকে যেতে চান তবে মেঘালয় অথবা বিআরটিসি যেকোনো নরসিংদীগামী বাসে করে যেতে পারেন।
প্রথমে আপনাকে যেতে হবে পাঁচদোনায়। বাস ভাড়া গুনতে হবে জনপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এখন গন্তব্য ডাংগা বাজার, এখান থেকে সিএনজি করে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন। এর পর ৩০ থেকে ৪০ টাকা ভাড়ায় রিক্সা নিয়ে ১ কিলোমিটার পেরোলেই লক্ষন সাহার জমিদার বাড়ি।
কুড়িল বিশ্বরোড – নরসিংদী
গুলিস্থান দিয়ে না গিয়ে অন্যভাবে যাওয়ার কোন প্ল্যান করছেন? চাইলে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বিআরটিসি সরাসরি পারেন পাঁচদোনায়। ভাড়া ১০০ টাকা। পাঁচদোনা থেকে কিছুক্ষণ পর পর ডাঙ্গা বাজারের উদ্দ্যেশে সিএনজি ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। ডাঙ্গা বাজারে নেমে ১৫ টাকায় একটি রিক্সা ভাড়া করে চলে যান উকিল বাড়িতে। স্থানীয়রা এটিকে উকিল বাড়ি বলেই চেনে।
অথবা ৩০০ ফিট ধরে কাঞ্চন ব্রিজ এর পর মায়ের বাড়ি মোড়ে নেমে সরাসরি অটোরিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবেন জমিদার বাড়িতে।
গাজিপুর- নরসিংদী
জমিদার বাড়ি দেখার জন্য বাসে কিংবা লেগুনায় করে আব্দুল্লাহপুর বা টংগী থেকে আপনাকে যেতে হবে কালিগঞ্জে। এরপর শীতলক্ষ্যা নদীর পার থেকে ডাংগাগামী নৌকায় চড়ে বসুন। চাইলে পুরো নৌকা ভাড়াও করতে পারেন। ডাংগা পৌঁছানোর পর রিকশায় সরাসরি জমিদার বাড়ি যেতে পারবেন।
তাছাড়া টঙ্গি বা আবদুল্লাহ বাস স্ট্যান্ড থেকে পিপিএল / উত্তরা / চলনবিল বাসে করে চলে আসুন ঘোড়াশাল ব্রিজের মাথায়। ব্রিজের নিচে গেলেই দেখতে পাবেন ডাঙ্গা বাজারের উদ্দ্যেশে সিএনজি ছেড়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২০ টাকা। তারপর ডাঙ্গা বাজার থেকে একটি রিক্সা ভাড়া করে চলে যান জমিদার বাড়িটি দেখতে।
খাওয়ার ব্যবস্থা
জমিদার বাড়ির আসেপাশে খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা না থাকায় খাওয়ায় জন্য যেতে হবে ঘোড়াশাল বাসস্ট্যান্ড বাজার বা পাঁচদোনা মোড়ে । ফাইফ স্টার না হলেও খাওয়ার হোটেল পেয়ে যাবেন একখানে। খাবার খরচও বেশি না ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় ভরপেট খাওয়া হয়ে যায় একজন মানুষের।
থাকবেন কোথায়
আপনি যদি নরসিংদীতে থাকতে চান তবে সবচাইতে ভালো হবে সরকারী গেস্ট হাউজে থাকা। নরসিংদীতে কয়েকটি সরকারি গেস্ট হাউজ রয়েছে।
- নরসিংদী সার্কিট হাউজ
ফোনঃ ০২৯৪৬২০৮৩।
- জেলা পরিষদ পোস্টাল বাংলো
ফোনঃ ০২৯৪৬৩৭৬৫।
- রেস্ট হাউজ, সিভিল সার্জেনের কার্যালয়
ফোনঃ ০২৯৪৬২২৬০।
এছাড়াও কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে এই জেলায়।
- হোটেল নিরালা
ফোনঃ ০১৭১১১৯৬৬৯৯।
- আরাফাত হোটেল
ফোনঃ ০১৭১২১৩০১৩৯।
আশেপাশের আরও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
- ড্রিম হলিডে পার্ক
- গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি
- মেঘনা নদীর পাড়
- আটকান্দি মসজিদ
- পারুলিয়া মসজিদ
- সোনাইমুড়ি টেক
- আটকান্দি মসজিদ
- উয়ারী বটেশ্বর
- বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান জাদুঘর
- শাহ ইরানী মাজার
- দেওয়ান শরীফ মসজিদ
- আশ্রাবপুর মসজিদ
- বেলাব বাজার জামে মসজিদ
সতর্কতা
- জমিদার বাড়িটিতে মাঝে মধ্যে এলাকার বাজে ছেলেদের নেশা করতে দেখা যায়, তাই তাদের থেকে যথাসম্ভব দুরত্ব বজায় রেখে ঘুরবেন। সম্ভব হলে গ্রুপ করে যাবেন বা স্থানীয় কাউকে সাথে করে নিয়ে যাবেন।
- ময়লা আবর্জনা ফেলে জমিদার বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
- অপরিচিত স্থানে শিশুদের একা না ছেড়ে বাড়তি নজর রাখুন।
ছবিটি তুলেছেনঃ Monzur Khan