সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
শেয়ার করুন সবার সাথে

বাংলাদেশের মোট ২০ টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি । সিলেট বিভাগে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কিছু জায়গা সবচেয়ে জনপ্রিয়, সিলেটের হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান তার মধ্যে অন্যতম। এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ উদ্যান।
২০০৫ সালে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পায় এ উদ্যান।এখানে আছে চা বাগান,নানা প্রজাতির গাছ,পশু-প্রাণী,আদিবাসীসহ আরও অনেক কিছু যা দেখার জন্য এ জায়গাটি ভ্রমণ করা উচিৎ।দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবছর বহু লোক এখানে আসে ভ্রমণ করতে। কারণ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু চোখের দেখার জন্যই নয়,বরং এ উদ্যানে এলে জানার ও গবেষণার অনেক বিষয় আছে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান কোথায় অবস্থিত?

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের অন্যতম জেলা হবিগঞ্জ।আর হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নে রঘুনন্দন নামে পাহাড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবস্থিত।এটিই এখন সাতছড়ি নামে পরিচিত।
এ জেলায় আছে পাহাড় ও টিলার আধিক্য। আর পাহাড়ের মাঝে আছে ঝর্ণা বা ছড়ি।এরকম পাহাড়, ঝর্ণা,বন্য প্রাণী,বৃক্ষ সব নিয়ে সাতছড়ি উদ্যানটি গঠিত।এ উদ্যানটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং মিশ্র চিরহরিৎ পাহাড়ি বন।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের আয়তন কত?

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের আয়তন মোট ২৪২.৮২ হেক্টর বা ৬০০ একর। এ উদ্যান মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা থেকে ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হবিগঞ্জে অবস্থিত। যদিও এটি লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্টের চেয়ে কম জনপ্রিয়, তবে এতে গাছপালা ও প্রাণীর বৈচিত্র্য বেশি এবং মানুষের ভীড় অনেক কম।
ভারতীয় উপমহাদেশ ও উন্দো চীনের সংযোগস্থলে অবস্থিত এ বনভূমি হাজার বছরের পুরোনো। এ উদ্যানটিকে ট্রপিকাল রেইন ফরেস্ট এবং পাতাঝড়া বন বলা যায় ।

উদ্যানটির নামকরণ কীভাবে হল?

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের “সাতছড়ি” শব্দটি একটি বাংলা শব্দ যার অর্থ ‘সাতটি ছড়া’ বা ‘সাতটি পাহাড়ি ঝর্ণা’। বনের ভিতরে প্রবাহিত সাতটি ছড়ির নামানুসারে পার্কটির নাম হয়েছে “সাতছড়ি”। এই ছড়ি বা ঝর্ণাগুলি বন্যপ্রাণীর জন্য পানি সরবরাহ করে এবং পার্কের বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।এটি শুষ্ক মৌসুমে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব পূরণ করে ।
সাতছড়ির আগের নাম ছিল “রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট”। রঘুনন্দন পাহাড়ের সংরক্ষিত বনের অবশিষ্ট প্রাকৃতিক বনভূমি সংরক্ষনের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে সাতছড়ি নামে উদ্যানটি গঠন করা হয়।

সাতছড়ি উদ্যানে দেখার কি কি আছে?

এ জাতীয় উদ্যানটি বেশ কয়েকটি চা বাগান, গ্রাম, শহর এবং আবাদি জমি দিয়ে ঘেরা। এর কাছে রয়েছে ৯টি চা বাগান। বনের পশ্চিম পাশের চা বাগানটির নাম সাতছড়ি এবং পূর্ব পাশের চা বাগানটির নাম চাকলাপুঞ্জি । পার্কের ভিতরে টিপরাপাড়া নামে একটি গ্রাম রয়েছে । এ গ্রামে ২৪টি টিপরা আদিবাসী পরিবার বসবাস করে। শান্ত টিপরাপাড়া পার্কের একটি রত্ন।বন ভ্রমণে গেলে টিপরা জাতিগোষ্ঠীর দেখা অবশ্যই পাওয়া যাবে।
কারণ এই সম্প্রদায়টি দীর্ঘদিন ধরে বনেই বসবাস করে বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। বর্তমানে উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনার সাথে বেশ কিছু টিপরা যুবক এখন ট্যুরিস্ট গাইড হিসাবে জীবিকা অর্জন করে।তবে অন্যান্য পরিবারগুলি তাদের পেশায় বৈচিত্র্য এনেছে।
এ উদ্যানে প্রায় ১৪৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, চাপালিশ, তাল, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধরাজারুল, মালেকাস, ইউক্যালিপটাস, বিষ, পিতরাজ, কানাইডিঙ্গা, আগরআখমনি, বাঁশ ও বেত গাছ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ১৯৭ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। আর প্রায় ১৪৯ প্রজাতির পাখি, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬ প্রজাতির উভচর আছে।
এ বনে দেখা মেলে নানা ধরণের বিরল বন্যপ্রাণীর, বিশেষ করে যারা পাখি-প্রেমী তাদের জন্য এটি সঠিক জায়গা ।বিরল পাখির মধ্যে আছে করমোরান্ট, রেড হেডেড ট্রোগন, কাঠঠোকরা প্রভৃতি । স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে আছে টিলা গিবন, মেছো বিড়াল,বন্যশুকর, নানা জাতের হনুমান ,সজারু ইত্যাদি যা এই পার্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য।উভচর ও সরীসৃপের মধ্যে আছে ব্যাঙ,কচ্ছপ, গিরগিটি,তক্ষক ইত্যাদি।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ জেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যেতে চাইলে বাসে করে সরাসরি হবিগঞ্জ যেতে হবে। এরপর সেখান থেকে লোকাল বাস বা অন্যান্য পরিবহনে করে ঐ স্থানে পৌঁছাতে হবে ।
এ উদ্যানটি ঢাকা থেকে প্রায় ১৩০ কিঃমিঃ দূরে হওয়ায় ঢাকা থেকে সড়ক পথে সময় লাগে প্রায় ৩/৪ ঘন্টা। আর শ্রীমঙ্গল হতে যেতে সময় লাগে প্রায় ১.৫ ঘন্টা।

বাসে কীভাবে যাবেন (ঢাকা থেকে)

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার জন্য দুটি বিকল্প পরিবহণ ব্যবস্থা রয়েছে। বাসে চড়ে বা ট্রেনে চড়ে। ঢাকা থেকে যাবার সহজ উপায় হল সিলেটগামী যেকোন বাসে মাধবপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে যাওয়া এবং সেখান থেকে একটি বাস বা ম্যাক্সিতে করে সাতছড়ি যাওয়া । হানিফ, গ্রীন লাইন, এনা, শ্যামলী, মিতালী, মামুন, মডার্ন, আল মোব্বারাকা, দিগন্ত, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি যেকোনো পরিবহনের বাসে ভ্রমণ করা যায়। জনপ্রতি বাসের টিকিটের মূল্য ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা হতে পারে।

ট্রেনে কীভাবে যাবেন (ঢাকা থেকে)

ঢাকা থেকে ট্রেনে হবিগঞ্জ যেতে হলে সায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে নামতে হবে। এখান থেকে শহরের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, উপবান এক্সপ্রেস আছে যা প্রতিদিনই বা সপ্তাহের বিভিন্ন সময় ঢাকার কমলাপুর থেকে ছাড়ে। ভাড়া ১০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।

প্রবেশ ফি ও টিকেটের মূল্য

★এ উদ্যানে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা।
★শিশু বা ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ ফি ১০ টাকা। ★বিদেশীদের জন্য $৫ ডলার পরিমাণ ফি।
★এছাড়া সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পিকনিক করতে গেলে বাগানে প্রবেশের সুযোগ থাকলেও তখন প্রতিজনের জন্য ১০ টাকা দিতে হবে। ★পার্কিং এর জন্য প্রতিটি গাড়ির পার্কিং ফি ৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা।

গাইড ফি

সাতছড়ি উদ্যানের তথ্য কেন্দ্র থেকে গাইড পাবেন। প্রতি ঘন্টায় বন ভ্রমণের গাইডলাইন পরিষেবা তথা গাইড ভাড়া নিতে পারেন ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। অফিস প্রাঙ্গনে ম্যাপ দেওয়া থাকলেও গাইড নিতে হবে । কারণ বনের শুরুতে ট্রেইল সম্পর্কে নির্দেশনা থাকলেও বনের ভেতরে কোথাও এরকম নির্দেশনা নেই। ফলে বনে ভুল করার সম্ভাবনা থাকে।

খাবেন কোথায়

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে কিন্ত থাকা বা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বনে খাবার সাথে করে নিয়ে যেতে পারেন। তবে সাতছড়ির বাইরে হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট বা দোকানে খাবারের ব্যবস্থা আছে।

থাকবেন কোথায়

সাতছড়িতে থাকার ব্যবস্থা নেই তবে রাতে দল বেঁধে ক্যাম্প করা যায় । আর বন বিভাগের অফিসের পূর্বানুমতি অবশ্যই নিতে হবে।
তবে বনের বাইরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় থাকার জন্য হোটেল আছে। যেমন হিল কটেজ ও রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের প্রধান প্রবেশপথের পাশে থাকার জন্য একটি কুটির আছে।
এছাড়া হবিগঞ্জ শহরের হোটেল সোনারতরী, হোটেল জামিল, হোটেল আমাদে (আমির চান কমপ্লেক্স) থাকা যাবে । এখানে ভাড়া ৮০০-২৫০০ টাকার মতো। আর আরও ভালো থাকার জায়গা চাইলে বাহুবল উপজেলায় অবস্থিত 5-স্টার রিসোর্ট প্যালেসে থাকতে পারেন (ভাড়া ৭০০০-১৫০০০ টাকা)।

ভ্রমণ টিপস

★ ভ্রমণের সেরা সময় হলো অক্টোবরের শুরু থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ।
★ বনের ভিতরে কোন রেস্টুরেন্ট নেই তাই সাথে খাবার এবং পানি নিতে হবে।
ছবিঃ রবি শঙ্কর দাস


শেয়ার করুন সবার সাথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!