সাদা পাথর

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর
শেয়ার করুন সবার সাথে

সাদা পাথর ভোলাগঞ্জ 

উঁচু উঁচু পাহাড়ের ওপরে মেঘেদের খেলা অবলোকন আর পাহাড়ের গা বেয়ে চলে আসা ঝর্নার শীতল পানিতে যদি নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চান, তাহলে আপনাকে আসতে হবে ভোলাগন্ঞ্জের সাদাপাথরে ( Sada Pathor Volaganj )। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কোলঘেষা একেবারে জিরোপয়েন্টে এর অবস্হান।

ব্রিটিশ শাসনামলে এই এলাকায় বিপুল পরিমান পাথরের মজুদ আছে ধারনা থেকে এটিকে বানিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ১৯৬৪ সালে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মান করা হয়েছিল রোপওয়ে। প্রায় ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রোপওয়েটি ব্যবহার করে পাথর নিয়ে আসা হত ভোলাগন্ঞ্জ থেকে। মেঘালয়ের পাহাড়ী ঢলের সাথে চলে আসা অসংখ্য পাথর এসে জমা হয় ধলাই নদীর উৎসমুখে। সেই পাথরগুলো উত্তোলন করে রোপওয়ের মাধ্যমে পাঠাতে হত ছাতকে। কালের পরিক্রমায় রোপওয়ের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাওয়ায় রোপওয়ের মাধ্যমে পাথর আনার কাজটিও স্হগিত হয়ে যায় আসতে আসতে। রোপওয়ের জন্য তৈরিকৃত টাওয়ারগুলো এখনো সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের স্বাক্ষী হয়ে জানান দিয়ে যাচ্ছে এখানে আসা পর্যটকদের। এখানকার পাথরগুলো বেশীর ভাগ সাদা রঙের বলেই স্হানীয়রা এই স্হানটিকে সাদাপাথর বলে ঢেকে থাকে। রোপওয়ের মাধ্যেম পাথর উত্তোলনের কাজটি এখন না হলেও স্হানীয়রা ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছে।

ভোলাগন্ঞ্জে আসার উপযুক্ত সময়

বর্তমানে জায়গাটি দেশের অন্যতম পাথর কোয়ারির অন্ঞ্চল হিসেবে সমাদৃত হওয়ার পাশাপাশি স্হান করে নিয়েছে পর্যটন শিল্পে। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপ্রেমী মানুষেরা প্রতিবছরই ছুটে আসেন সাদাপাথরে।



ভোলাগন্ঞ্জের ১০নং ঘাট থেকে সাদাপাথের নদীপথে যাওয়ার সময় মেঘালয়ের সবুজে মোড়ানো পাহাড়গুলো পর্যটকদের দৃষ্টি আর্কষন করে মন ভুলানো মেঘের রাজ্যে হারিয়ে নিয়ে যায় মুহুর্তেই। বর্ডার ঘেষা এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে হলে আপনাকে আসতে বর্ষার মৌসুমে। বিশেষ করে বছরের আগষ্ট মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধলাই নদীতে পানি থাকার দরুন এই সময়টাতে আসা ভালো। তাছাড়া বছরের অন্য সময়টাতে আসলে দেখতে পাবেন অন্য এক রূপ। বিশেষ করে বর্ষার শেষে এবং শীতের শুরুতে আসলে দেখতে পাবেন স্বচ্ছ পানির প্রবাহ। সেই সাথে পানির নীচে সাদা সাদা পাথরগুলিও।

যাবেন কিভাবে

দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ভোলাগন্ঞ্জে আসতে হলে আপনাকে যেতে হবে প্রথমে সিলেটে। সেখান থেকে সিএনজি, লেগুনা কিংবা বাসযোগে যেতে পারবেন কোম্পানীগন্ঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত ভোলাগন্ঞ্জ সাদা পাথরে। যেতে সময় লাগবে আনুমানিক ১ ঘন্টা।

বাসে ঢাকা থেকে সিলেটে

ঢাকার ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে সিলেট রুটে এসি-নন এসি সব ধরনের বাস চলাচল করে। শুধুমাত্র মহাখালী থেকে এনা নন এসি বাস চলাচল করে। ফকিরাপুল থেকে যে সমস্ত বাস সিলেটে যায় সেগুলো হচ্ছে হানিফ, শ্যামলী, এনা, গ্রীন লাইন, ইউনিক, মামুন ইত্যাদি।  এগুলোর ভাড়া ৪৫০ থেকো ৬০০ টাকা। এসি বাসসমূহের মধ্যে আছে এনা, গ্রীনলাইন। এগুলোর ভাড়া ১০০০ থেকে ১২৫০ টাকা। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে যে সমস্ত লোকাল বাসগুলো সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সেগুলো হল মিতালী, বিসমিল্লাহ পরিবহন। এগুলোতে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেটে

ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন অথবা বিমানবন্দর রেল স্টেশন থেকে সিলেটে আসার জন্য আপনাকে ওঠতে হবে পারাবত, জয়ন্তিকা, উপবন এবং কালনী এক্সপ্রেসের যে কোন একটিতে। আসনভেদে ভাড়া ২৬৫ থেকে ১০৯৯ টাকা।



রাতের ট্রেনে রওনা দিয়ে সকাল সকাল সিলেটে পৌঁছাতে চাইলে আপনাকে বেঁছে নিতে হবে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে। এটি বুধবার ছাড়া প্রতিদিনই ছেড়ে যায় সিলেটের উদ্দেশ্যে। স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় রাত ৮ঃ৩০ মিনিট। পৌঁছানোর সময় ভোর ৫ঃ০০ টা।

চট্রগ্রাম থেকে সিলেটে

চট্রগ্রাম থেকে সিলেটে আসার জন্য বাস এবং ট্রেন দুই ধরনের সার্ভিসই চালু আছে। বাসের মধ্যে আছে হানিফ, শ্যামলী, এনা ইত্যাদি। আর ট্রেনে আসতে চাইলে পাহারিকা এবং উদয়ন এক্সপ্রেসে করে আসতে পারেন। রাতের ট্রেনে করে আসতে চাইলে উদয়ন এক্সপ্রেসকে বেঁছে নিতে হবে। এটি ছাড়ার সময় রাত ৯ঃ৪৫ মিনিট। পৌঁছানোর সময় সকাল ৬ঃ০০ টা। আসনভেদে ভাড়া পড়বে ৩১৫ থেকে ১২৮৮ টাকা।

সিলেট থেকে সাদাপাথরে

সিলেটের যে কোন জায়গা বিশেষ করে কদমতলী বাস স্ট্যান্ড বা রেল স্টেশন থেকে একটা সিএনজি অথবা লেগুনা ভাড়া করে সরাসরি ভোলাগন্ঞ্জের ১০ নং ঘাটে যেতে পারবেন। আর সেখান সেখান ট্রলারে করে ২০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন সাদাপাথর। সারাদিনের জন্য একটা সিএনজি অথবা লেগুনা ভাড়া করে দেখে নিতে পারবেন মালনিছড়া চা বাগান, সাদাপাথর, রাতারগুল, আর রাতের সিলেটের শহর।

লেগুনা রিজার্ভ ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকায় এবং সিএনজি রিজার্ভ ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকায় পেয়ে যাবেন। আপনাদের সু্বিধার্থে এখানে একজন সিএনজি এবং একজন লেগুনা ড্রাইভারের দিয়ে রাখা হল। চাইলে উনাদের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ করে রিজার্ভ করতে পারেন। আর যারা একটু কম বাজেটে ভোলাগন্ঞ্জ যেতে চাচ্ছেন, তারা চাইলে লোকাল বাস বা সিএনজিতে করে যেতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, এইভাবে যেতে সময় লাগবে একটু বেশী। তাছাড়া চাইলেই যে কোন স্হানে নেমে ছবিও তুলতে পারবেন না।

সিলেটের মজুমদারী এলাকা থেকে বিভিন্ন লোকাল বাস, সিএনজি ভোলাগন্ঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সকাল ৭টা থেকে এগুলো ছেড়ে যায় প্রতি আধা ঘন্টা পরপর। বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৬০ টাকা এবং সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা পড়বে।



সিলেট শহর থেকে ভোলাগন্ঞ্জ যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট। ভোলাগন্ঞ্জ ১০ নং ঘাটে পৌঁছানোর পর ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ট্রলার ভাড়া ৮০০ টাকা। প্রতি ট্রলারে ৮ জন যেতে পারবেন। ঘাট থেকে সাদা পাথরে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। আর আপনি যদি সলো ট্রাভেলার হোন অথবা গ্রুপ যদি ছোট হয় তাহলে আরেকটি গ্রুপের লোকজনের সাথে আলাপ করে যেতে পারলে খরচ কমে যাবে। ট্রলারের মাঝিরা সাধারনত ঘন্টা দুয়েকের মত সময় দিয়ে থাকে সময় কাটানোর জন্য। চাইলে আরও কিছু সময় বাড়িয়ে নেওয়া যায়। যদি রাতারগুলে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে তাহলে দুপুর ১ টা থেকে ১ঃ৩০ মিনিটের মধ্যেই ঘাটে ফিরে আসতে হবে।

যদি রাতাগুলে যাওয়ার পরিকল্পনা না থাকে তাহলে সাদা পাথর থেকে ফিরার পথে দেখতে আসতে পারেন উৎমাছড়া আর তুরংছড়া। এর জন্য মাঝির সাথে আগেই আলাপ করে নিবেন, যেন সে আপনাদেরকে দয়ারবাজার ঘাটে নামিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু ভাড়া চাইতে পারে মাঝি। দয়ারবাজারে নেমে একটা সিএনজি বা বাইক নিয়ে চলে যাবেন চরারবাজারে। ভাড়া পড়বে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। চরারবাজারে নেমে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিবে উৎমাছড়া পয়েন্ট। ২০ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন উৎমাছড়া। আর তুরংছড়া যেতে চাইলে আপনাকে আবার ফিরে আসতে হবে চরারবাজার। সেখান থেকে একটি বাইকে করে চলে যাবেন তুরংছড়ায়। ভাড়া পড়বে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

খাবেন কোথায়

সাদা পাথরে যাওয়ার পূর্বে পানসি থেকে সকালের খাবার খেয়ে নিবেন। সিলেট শহরের জিন্দাবাজারে পানসি, পাঁচ ভাই রেস্ট্রুরেন্ট অবস্হিত। ভালোভাবে সকালের খাবার সারাদিনের ভ্রমণ ক্লান্তিকে অনেক কমিয়ে দেয়। তাই চেষ্টা করুন সাধ্যমত যেন সকালের খাবারটা পরিপূর্ন হয়। কারন ভ্রমণ বিরতি ব্যতিত খাবারের তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না, ভালোমানের খাবারের দোকানের সন্ধান পাওয়াও মুসকিল পর্যটন স্পটগুলিতে।

সাদা পাথরে খাবারের কোন সুব্যবস্হা নেই। তবে, ভোলাগন্ঞ্জ ১০ নং ঘাটে খাবারের কিছু দোকান পাবেন। সেখান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। তবে আপনার যদি রাতালগুল যাওয়ার প্ল্যান থাকে তাহলে পথিমধ্যে ভালো কোন হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারেন। সিএনজি বা লেগুনা ড্রাইভারের সাথে আলাপ করে ভালো কোন হোটেল থেকে খেয়ে নিন।

থাকবেন কোথায়

যেহেতু সকালে রওনা দিয়ে সারাদিন ঘুরাঘুরি করে আবার সন্ধ্যা বা রাতের মধ্যেই সিলেট শহরে আসা যায়, সেহেতু ভোলাগন্ঞ্জে থাকার চিন্তা না করাই ভালো। তবে, কারো যদি একান্তই থাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে কোম্পানীগন্ঞ্জ উপজেলা সদরে যেতে হবে। সেখানে সাধারন মানের কিছু হোটেল পেয়ে যাবেন।

শহরের কদমতলি বাস স্ট্যান্ড, দরগা রোড, ইত্যাদি স্হানে বিভিন্ন মানের হোটেল পাবেন। এগুলোতে সাধারনত প্রতি রাতের ভাড়া ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা হয়ে থাকে। চাইলে দর কশাকশি করে ভাড়া আরও কমানো যায়। তাই, ভালো দর কশাকশি করতে পারে এমন কাউকে দিয়ে ভাড়া ঠিক করুন।

ভ্রমণ সতর্কতা

  • সাঁতার না জানলে বেশি পানিতে গোসল করতে যাবেন না।
  • সাতার না জানলে নৌকায় ওঠার পূর্বে লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখুন।
  • সন্ধ্যার পূর্বে সিলেট শহরে পোঁছানোর চেস্টা করুন।
  • বর্ডারের সীমানা অতিক্রম করবেন না।

ছবি ও লেখকঃ Monzur Khan


শেয়ার করুন সবার সাথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!