হরিপুর জমিদার বাড়ির ইতিহাস
হরিপুর নামের ছোট্ট একটা গ্রাম। তিতাস নদীর পাড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে তিনতলার বিশাল এক রাজবাড়ি। এই অনন্য সুন্দর স্থাপনা নিমিষেই মন কাড়ার মত। এমনকি প্রথম দেখায় আপনার কাছে অনেক চেনা চেনাও মনে হতে পারে। তার কারণ, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহমেদের সর্বশেষ তৈরী সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র শুটিং হয়েছিল ঠিক এখানটায়।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা নাসিরনগর। উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে হরিপুর ইউনিয়ন। গ্রামের নামটাও সুন্দর; হরিণবেড়। এখানে প্রায় ১৭৫ বছর আগে তৎকালীন জমিদার গৌরী প্রসাদ রায়চৌধুরী ও কৃষ্ণ প্রসাদ রায়চৌধুরী একটি জমিদার বাড়ি তৈরী করেন যেটা হরিপুর জমিদার বাড়ি (Haripur Jomidar Bari) নামে প্রসিদ্ধ। উত্তরাধিকার সূত্রে উপেন্দ্র রায়চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায়চৌধুরী বাড়িটির মালিকানা লাভ করলেও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর তারা স্থান ত্যাগ করে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সেই সময় জমিদার বাড়িটির দায়িত্ব দিয়ে যান পুরোহিতদের উপর। ১৯৪৭ সনের সেই ঘটনার পর বর্তমানে বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রক্ষিত আছে।
এই বড়বাড়ির ঠিক পূর্ব পাশে মাধুবপুর সড়ক। মুল বাড়িটি ৪৮০ শতাংশ বা প্রায় ৫ একর জমির উপর নির্মিত। লাল ইটের দৃষ্টিনন্দন ভবনটিতে রয়েছে সর্বমোট ৬০টি কক্ষ। এছাড়াও আছে রঙমহল, গোয়ালঘর, মল পুকুর, রন্ধনশালা, নাচ ঘর এমনকি খেলার মাঠ। বাড়ির পশ্চিম পাশে দেখা পাবেন সুন্দর শান বাঁধানো ঘাটের। ঘাটের উত্তর দিকেই চোখে পড়বে বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণ প্রসাদ রায়চৌধুরী এবং গৌরী প্রসাদ রায়চৌধুরীর সমাধি মঠ।
তিতাস পাড়ের এই জমিদার বাড়িতে কোন রডের গাঁথুনি নেই। লাল ইটের দালানের পলেস্তেরা খুলে পড়ছে। জরাজীর্ণ রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু এর শৈল্পিক আবেদন কমেনি এক বিন্দু। বাড়িটি তৈরীর এত বছর পরেও উল্লেখযোগ্য কোন পরবর্তন আসেনি। দেশ বিভক্তির পর ভবনটির দেখাশোনার দায়িত্ব পুরোহিতদের উপর থাকায় এখনো সেখানে তাদের বংশধররেরা বসবাস করে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ টি পরিবার রয়েছে সেখানে।
ভবনের দুই পাশে রয়েছে দুইটি সুউচ্চ গম্বুজ। যেগুলো শুধু বাড়িটির শোভা বৃদ্ধিই নয় বরং এত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে অটল। ভবনের দুইতলায় যেতে ছয় দিক থেকে ছয়টি সিড়ি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় তলা থেকে উপরে উঠতে রয়েছে দুইটি সিড়ি। উওর-পশ্চিম কোণে রয়েছে মোট ছয়টি শয়নকক্ষ। মলপুকুরের ঠিক পূর্বদিকে চারটি এবং পশ্চিমদিকে রয়েছে আরো চারটি শয়নকক্ষ।
শুধু ঐতিহাসিক গুরুত্ব নয় এমনকি অনেক নন্দিত চলচ্চিত্রের লোকেশন হিসেবে এই জমিদার বাড়িটি ব্যবহৃত হওয়ার অনেকেই চলে আসেন তিতাস পাড়ের এই ছোট্ট গ্রামটিতে। ঘেটুপুত্র কমলা ছাড়াও মধুমালতি, নাইওরী সহ বেশকিছু কালজয়ী সিনেমা চিত্রায়িত হয়েছে এখানে।
যাবেন কিভাবে
ঢাকা থেকে হরিপুর জমিদার বাড়িটি দেখতে উঠে যেতে পারেন হবিগঞ্জ বা সিলেটগামী বাসে। খুব ভালো হয় ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে গেলে। ঢাকার সায়দাবাদ থেকে হবিগঞ্জ বা সিলেটগামী বাস গুলোর মধ্যে হানিফ, শ্যামলী, এনা, দিগন্ত, অগ্রদূত, মিতালী বিছমিল্লাহ পরিবহন সার্ভিস দেয়। বাসগুলো সাধারণত ভোর ৫.৪৫ থেকে শুরু করে দুই-তিন ঘন্টা অন্তর অন্তর ছাড়ে। টঙ্গী বাস স্টেশন থেকে সরাসরি যেতে চাইলে উঠতে হবে এনাতে। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী বাস যেমন ইকোনো, উত্তরা পরিবহনে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ব রোডে নেমে সিলেট বা হবিগঞ্জগামী বাসে চড়ে নেমে পড়বেন মাধবপুর বাস স্ট্যান্ডে।
মাধবপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে সিএনজি বা অটোতে যাওয়া যায় বাড়িটির একদম সামনে। ভাড়া পড়বে ১০-১৫ টাকা।
এছাড়াও ট্রেনযোগে যেতে চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী যেকোন ট্রেনের টিকেট কেটে রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনাকে নামতে হবে নয়াপাড়া ষ্টেশনে।
ভোরের দিকে রওনা দিলে সকাল ১১ টার ভেতরেই পৌঁছে যাবেন নির্ধারিত গন্তব্যে। ফিরতে পথে ৬ টা ২০ এর ঢাকাগামী পারাবত এক্সপ্রেস ভালো মাধ্যম হতে পারে তবে সেক্ষেত্রে নয়াপাড়া পৌঁছাতে হবে সন্ধ্যার আগে।
থাকার ব্যবস্থা
যেহেতু ঢাকা থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দূরত্ব তেমন বেশী না, তাই ভোরে রওনা দিলে রাতের ভেতরেই ফেরত আসতে পারবেন। তবে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে চলে আসতে হবে মাধবপুর বাজারে। সেখানেই পেয়ে যাবেন বিভিন্ন রেস্ট হাউজ। এদের মধ্যে হাইওয়ে রেস্ট হাউজ, ভিশন হোটেল তুলনামূলকভাবে ভালো। খরচও নাগালের মধ্যে। এছাড়াও জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজেও থেকে যেতে রাতটা।
আরো দেখতে পারেনঃ
হরিপুর জমিদার বাড়ি ছাড়াও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোঃ
- ধরন্তি হাওর
- আরিফাইল মসজিদ
- আবি রিভার পার্ক
- মেদিনী হাওড় অঞ্চল
- বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু
- কেল্লা শাহ মাজার
- জয়কুমার জমিদার বাড়ি
- শ্রীঘর মঠ
- বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর
এই বাড়িটির ভিডিও দেখুনঃ হরিপুর জমিদার বাড়ি