বিরিশিরি

নেত্রকোনার-দর্শনীয়-স্থান
শেয়ার করুন সবার সাথে

অপরুপ সৌন্দর্যের এক অনন্য সৌন্দর্য, এক দর্শনীয় স্থান বিরিশিরি (Birishiri)। ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সুসং গ্রামে অবস্থিত এই অলৌকিক সৌন্দর্য। ছোট ছোট পাহাড়ের টিলায় উঠে জুড়িয়ে যায় চোখ দুটো সবুজের সেই মহিমাময়ী সৌন্দর্যে। ছুটে চলা দৃষ্টিতে ধরা দেয় সীমান্তের ওপাড়ে থাকা পাহাড়ের চূড়াগুলো। প্রকৃতির এ কি অবলীল খেলা! মুগ্ধ হওয়ার ভাষা যেন হয়ে যায় নির্বাক, যেন হাতরে বেড়ায় নতুন কোন এক ভাষা অভিভূত হয়ে থমকে যাওয়া এই মুহূর্তে। ছোট ছোট টিলা পাহাড়ের চূড়ায় বসে চারিদিকের মনোরম পরিবেশটাকে চোখের পলকে রূপকথার গল্পের মত করে উপভোগ করার মত এমন এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতির সাধ নেওয়া কেবল বিরিশিরিতেই সম্ভব।

যার অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা যতটা দেয়া হয় ততোই যেন কম পরে যায়। এ যেন কোন এক নিপুণ চিত্র-কারিগরের নিখুঁত কারুশিল্প। সাদা মাটির এই অপরূপ গ্রামটি ভারতের সেই চিরচেনা সৌন্দর্য মেঘালয় রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে বিজয়নগর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী সোমেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত।

কিভাবে বিরিশিরি যাবেন

বিরিশিরি বাস এবং ট্রেন দুই পথেই যাওয়া যায়। মহাখলী বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বিরিশিরির বাস আছে। প্রায় ৭ ঘন্টার মত সময় লাগে ঢাকা থেকে বিরিশিরি পৌঁছোতে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা বা অটোতে ঘাট এ পৌঁছোতে পারবেন। ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জারিয়া স্টেশন ট্রেন যাত্রার শেষ গন্তব্য। ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে প্রতিদিন ৩টি ট্রেন জারিয়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জারিয়া স্টেশন থেকে অটো বা টেম্পোতে চরে পৌঁছতে হবে দুর্গাপুর গ্রামে



আর এই দুর্গাপুর গ্রামটির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে সেই সোমেশ্বরী নদী। এখান থেকেই মূলত ভ্রমনের আসল যাত্রা শুরু। সকল দর্শনীয় স্থানগুলো সোমেশ্বরীর ওপাড়েই অবস্থিত। দুর্গাপুর গ্রামের এই ঘাট থেকেই মোটর বাইক অথবা অটোরিকশা রিজার্ভ করে নিয়ে দেখতে যেতে হবে সব দর্শনীয় স্থানগুলো। জনপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা করে পরবে।

দুর্গাপুর দর্শনীয় স্থানসমূহ

বিরিশিরিঃ আঁকাবাঁকা কাঁচা মেঠো পথ এগিয়ে যাওয়া রঙিন পানি ঘেরা সেই গোলাপি চীনামাটির পাহাড় বিরিশিরি!! এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ মহিমা। বিরিশিরির টিলা পাহাড়ে উঠতে কিছুক্ষন পর পর লক্ষ করলে দেখতে পাওয়া যায় রঙিন মাটি। এখানে প্রায় দশ রঙের মাটির দেখা পাওয়া যায়। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নীল-সবুজ পানি, চারিদিকের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, গোলাপি পাহাড় তারপর সীমানার ওপাড়ে মেঘালয়ের পাহাড়ের সৌন্দর্য যেন পুরোটাই একটি বাস্তবিক রুপকথা।

সোমেশ্বরী নদীঃ মেঘালয় রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে বিজয়নগর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সোমেশ্বরী নদী। ভ্রমন-যাত্রার প্রথমেই পাড়ি দিতে হবে সেই ঐতিহ্যবাহী সাদা মাটির তীরের সোমেশ্বরী নদী। ইঞ্জিনযুক্ত নৌকাই একমাত্র অবলম্বন। সীমান্তের বিজিবি ক্যাম্পের ওখানে দেখতে পাওয়া যায় সোমেশ্বরীর আরেক অদ্ভুত রূপ। সীমান্তের এই জায়গাটায় নদীর পানি এতটাই স্বচ্ছ যা মনকে বিমোহিত করার জন্য যথেষ্ট।

সোমেশ্বরী নদীর তীরে রয়েছে পাথর, কয়লা ও বালুর খনি। এই কয়লা,পাথর, বালু সংরক্ষন করে চলে অনেকের জীবিকা। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে সাদা মাটি অন্যতম খনিজ সম্পদ। আর এই খনিজ সম্পদ সংগ্রহের সবচেয়ে বৃহৎ অঞ্চল এটি। সমতল ভূমি, ছোট-বড় টিলা সহ প্রায় ১৫. কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৬০০ মিটার প্রস্থ জুড়ে এই খনিজ অঞ্চলের বিস্তৃতি। চীনা মাটি খননের সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি তবে ধারনা করা হয়ে থাকে ১৯৫৭ সাল থেকে এই মাটি খননের যাত্রা শুরু। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে সাদা মাটির পরিমান ২৪ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন ধরা হয়েছিল ১৯৫৭ সালে যা কিনা বাংলাদেশের ৩ শত বছরের চাহিদা পূরণে
সক্ষম।

সাধু যোসেফের ধর্মপল্লীঃ দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। ধর্মপল্লী খোলা থাকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত। এটি ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের একটি উপসনালয়। এখানে রয়েছে একটি বিশ্রামাগারও। এর মনোরম পরিবেশ মুগ্ধ করবে নিশ্চিত।



রাণী খং উচ্চ বিদ্যালয়ঃ সাধু যোসেফের ধর্মপল্লীর কাছাকাছিই রয়েছে রাণী খং উচ্চ বিদ্যালয়। রাণী খং উচ্চ বিদ্যালয়টির প্রাঙ্গনটি মনোমুগ্ধকর। টিলাময় প্রাঙ্গনটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি অনন্য রূপ। শোনা যায় খং-রাণী নামক এক রাক্ষস এই অঞ্চলে বাস করতো। গারো সপম্রদায়ের লোকেরা ঐ রাক্ষসকে মেরে এই অঞ্চলে শান্তি এনেছিল আর ঐ রাক্ষসের নাম অনুসারে এই অঞ্চলের নাম রাণী খং।

রাণী মাতা রাশমনী স্মৃতিসৌধঃ দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে রাণী মাতা রাশমনী স্মৃতিসৌধ। বছর বছর ধরে স্মৃতিসৌধটির সৌন্দর্য যেন অক্ষত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। রাণী মাতা রাশমনী হাজন ছিলেন টংক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। ১৮৯৮ সালে তিনি ধোবাউড়া উপজেলায় দেবীকুড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে কুমুদিনী হাজং কে বাচাতে গিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্যদের গুলিতে তার সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজংসহ বহেরাতলী গ্রামে তিনি শহীদ হন। তার স্মরণে প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারী রাশমনী দিবস এবং টংক শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। রাণী রাশমনী হাজং এবং সুরেন্দ্র হাজং টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ।

বিরিশিরি কালচারাল একাডেমীঃ দেখার মত আরোও একটি স্থান হচ্ছে বিরিশিরি কালচারাল একাডেমী। ১৯৭৭ সালে একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি দ্বিতল ভবন সাথে রয়েছে একটি রেস্ট হাউস। এখানে মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি চর্চা করা হয়ে থাকে। প্রতি বছরই এখানে সাংস্কৃতিক বাৎসরিক আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী আদিবাসীয় সংস্কৃতি অনেক মনোমুগ্ধকর। স্থানীয়দের সহযোগীতায় আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যকে অনেক যত্নে লালন ও সংরক্ষন করে আসছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসীদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সংরক্ষন, উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার সহয়ার্থে “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০” কার্যকর করা হয়। বিরিশিরি কালচারাল একাডেমী এই আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।

কমলা বাগানঃ আরো একটি চোখ জুড়ানো স্থান হচ্ছে কমলা বাগান। যদিও নাম কমলা বাগান , কমলার দেখা কিন্তু ওখানে পাওয়া যাবে না। কমলা বাগানে রয়েছে একটি ছোট টিলা। টিলা বেয়ে উপরে ওঠার জন্য সাথে জুতা রাখা ভালো। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে দেখা যায় চারিদিকের মোহময়ী সবুজের বিস্তৃতি এবং সীমান্তের ওপাড়ের মেঘালয় রাজ্যেরপাহাড়ের চূড়া।

কোথায় থাকবেন 

রুপকথার মত এই অপরূপ সৌন্দর্য গুলো ঘুরে দেখার জন্য একদিনই যথেষ্ট। প্রকৃতির এইসব অপরূপ সৌন্দর্যবুকে বহন করে আছে ছোট্ট সুসং গ্রাম। দূরদূরান্ত থেকে জার্নি করে গিয়ে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন সেক্ষেত্রে আগেরদিন গিয়ে রাত্রিযাপন করে পরেরদিন সময় নিয়ে উপভোগ করতে পারেন ভ্রমণের আনন্দ। বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ড এর আশেপাশে আছে কিছু আবাসিক হোটেল। বিচিত্রা গেস্ট হাউস,স্বর্ণা গেস্ট হাউস, ওয়াই এম সি এ গেস্ট হাউস এছাড়াও আরোও কিছু আবাসিক হোটেল আছে বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে।

কোথায় খাবেন

খাবারের জন্য হোটেল নিরালা অনেক জনপ্রিয় এখানে। বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ড থেকে ২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থান এই খাবারের হোটেলটির। স্থানীয় যেকোন মানুষকে জিজ্ঞেস করলে পথ চিনিয়ে দিবে। সকাল, দুপুর ও রাতে সব টাটকা খাবার পাবেন এখানে।

পরিশেষে একটি কথাই স্বীকার্য যে কর্মব্যস্তময় জীবনের এই যান্ত্রিকতায় যখন সময় মিলানো এক দুষ্কর বিষয় তখন এক দিনে এই সাদা মাটির গ্রামের রুপকথা উপভোগই হতে পারে তার উপযুক্ত সমাধান।

আরও পড়ুন


শেয়ার করুন সবার সাথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!