স্বপ্নের ঢাকা মেট্রোরেল বাংলাদেশের জন্য এখন বিমূর্ত বাস্তবতা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের একাংশ চালু করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করে আধুনিক বৈদ্যুতিক পরিবহনের জগতে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঢাকার যানজটে আটকে পড়া থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে ২০১২ সালে এই মেট্রোরেল প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়। ২০২২ সালে এসে তা বাস্তবায়িত হয়।
বর্তমানে দৈনিক লক্ষ লক্ষ যাত্রীকে এক ঘণ্টার কম সময়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বহন করার ক্ষমতা রয়েছে মেট্রোরেলের । এই আধুনিক এবং দক্ষ পরিবহণ মাধ্যমটি যাত্রী ও পর্যটক উভয়কেই স্বল্পভাড়ায় সেবা দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত।
আজকের আর্টিকেল থেকে ঢাকা মেট্রোরেল, মেট্রোরেল প্রকল্প, মেট্রোরেল কোথায় থেকে কোথায় যাবে, কয়টি স্টেশন,সময়সূচি,ভাড়ার তালিকা,কখন বন্ধ থাকে ইত্যাদি তথ্য জানা যাবে।
ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প কবে শুরু হয় ?
ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প প্রথম ২০১২ সালে শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা ‘মেট্রো রেল’ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যা ২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়।
অনুমোদনের পরে ২০১৩ সালে মেট্রোরেল নির্মাণে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করে সরকার। নকশা প্রণয়ন শেষে ২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি লাইন-৬ তথা মেট্রোরেলের কাজ উদ্বোধন হয়।আর ২০১৭ সালের আগস্টে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়।
বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলির যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে মেট্রোরেল তৈরি করা হচ্ছে । জাপানি কোম্পানি জাইকার সাথে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড বা (ডিএমটিসিএল)।
ঢাকা মেট্রোরেল সম্পর্কে কিছু সাধারন তথ্য
- ঢাকা মেট্রোরেল বিদ্যুৎ চালিত রেল ব্যবস্থা
- এই রেলব্যবস্থা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা (এমআরটি) নামে পরিচিত
- প্রায় ১২৮ কি.মি. দীর্ঘ মেট্রোরেল লাইনের ২১.২৬ কি.মি. বর্তমানে যাতায়াতের জন্য প্রস্তুত
- এর মোট নির্মাণ ব্যায় ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা
- মেট্রোরেলে চড়তে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৫ টাকা
- মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
- মেট্রোরেলের প্রথম নারী চালক মরিয়ম আফিজা
- মেট্রোরেলে প্রতি ঘন্টায় বিদ্যুৎ খরচ ১৩.৪৭ মেগাওয়াট
- মেট্রোরেলের রুটে ট্রেন সংখ্যা ২৪ টি
- উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট
মেট্রোরেল কবে উদ্বোধন করা হয় ?
ঢাকা মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ উত্তরার দিয়াবাড়িতে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেল উদ্বোধনের পরে সবুজ পতাকা উড়ানোর মাধ্যমে প্রথম ট্রেনটির যাত্রার সূচনা করেন।
এর পরে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথিবৃন্দ দ্বিতীয় ট্রেনে চড়ে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁওয়ে যাত্রা করেন।২৯ ডিসেম্বর থেকে সর্বসাধারণের জন্য মেট্রোরেল খুলে দেওয়া হয়।
তবে মেট্রোরেলের মতিঝিল পর্যন্ত লাইন-৬ আগামী অক্টোবরেই চালু হবে।আর কমলাপুর পর্যন্ত সম্পূর্ণ লাইন চালু হতে ২০২৫ সাল নাগাদ সময় লাগবে।
কোথায় কোথায় মেট্রোরেলের কতটি স্টেশন আছে ?
মেট্রোরেলে যাতায়াত সহজ করার জন্য মোট ১৭ টি স্টেশন তৈরি করা হয়েছে।এই স্টেশনগুলোর অবস্থান উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। অবশ্য সব লাইন পুরোদমে চালু হলেই সব স্টেশন চালু হবে। স্টেশনগুলো হলো:
১/ উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি),
২/উত্তরা সেন্টার
৩/উত্তরা দক্ষিণ
৪/পল্লবী
৫/মিরপুর–১১
৬/মিরপুর–১০
৭/কাজীপাড়া
৮/শেওড়াপাড়া
৯/আগারগাঁও
১০/বিজয় সরণি
১১/ফার্মগেট
১২/কারওয়ান বাজার
১৩/শাহবাগ
১৪/টিএসসি
১৫/প্রেসক্লাব
১৬/মতিঝিল
১৭/ কমলাপুর
বর্তমানে মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মাঝে ৯টি স্টেশনে থামছে। তা হলো:
১/ উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি),
২/উত্তরা সেন্টার
৩/উত্তরা দক্ষিণ
৪/পল্লবী
৫/মিরপুর–১১
৬/মিরপুর–১০
৭/কাজীপাড়া
৮/শেওড়াপাড়া
৯/আগারগাঁও
তবে মতিঝিল পর্যন্ত লাইন চালু হলে প্রথমদিকে মাত্র ৩ টি স্টেশনে যাত্রী উঠানামা করবে। স্টেশনগুলো হলো :
১/মতিঝিল
২/সচিবালয়
৩/ফার্মগেট
মেট্রোরেলের ভাড়ার তালিকা ২০২৩
ঢাকা মেট্রোরেলে চড়তে হলে অবশ্যই টিকিট কেটে ভাড়া মিটাতে হবে।মেট্রোরেলের ভাড়া দূরত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে।
প্রতি কিলোমিটারে জনপ্রতি ৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন ২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। আর প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ছাড়।
মেট্রোরেল লাইন-৬ এর ১৭ টি স্টেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা ২০২৩:
★উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে
উত্তরা সেন্টার–২০/-
উত্তরা সাউথ-২০/-
পল্লবী – ৩০/-
মিরপুর-১১ নম্বর – ৩০/-
মিরপুর-১০ নম্বর – ৪০/-
কাজীপাড়া – ৪০/-
শেওড়াপাড়ায় – ৫০/-
আগারগাঁও – ৬০/-
বিজয়সরনী – ৬০/-
ফার্মগেট – ৭০/-
কারওয়ানবাজার – ৮০/-
শাহবাগ – ৮০/-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – ৯০/-
সচিবালয় – ৯০/-
মতিঝিল – ১০০/-
কমলাপুর – ১০০/-
আবার কমলাপুর স্টেশন থেকে উত্তরার দিকে যেতে ভাড়ার তালিকা একই হারে নির্ধারিত হবে।
মেট্রোরেলে চলাচলের জন্য দুই ধরনের টিকিট রয়েছে। ‘সিঙ্গেল জার্নি টিকিট’ এবং ‘এমআরটি পাস।’স্টেশনের টিকিট অপারেশন মেশিন (টিওএম) থেকে টিকিট বিক্রয়কারীর সহায়তায় টিকিট কেনা যাবে।
আর টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) থেকে যাত্রীরা নিজে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে টিকিট ক্রয় এবং এমআরটি পাস রিচার্জ করতে পারবেন।এছাড়া অনলাইন পদ্ধতিতে মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন্সের মাধ্যমেও এমআরটি পাস রিচার্জ করা যাবে।
মেট্রোরেলের সময়সূচি ২০২৩
বর্তমানে মেট্রোরেল চলার সময়সূচি হলো সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত মোট ১২ ঘণ্টা। সকাল ৮-১১ টা এবং দুপুর ৩-৬ টা পর্যন্ত “পিক আওয়ার”। তাই এই সময় ট্রেন আসবে ১০ মিনিট পর পর।
আর বেলা ১১-৩ টা এবং সন্ধ্যা ৬-৮ টা পর্যন্ত সময়ে যাত্রীর চাপ কম থাকায় “অফ পিক আওয়ার”।এই সময় ট্রেন আসবে ১৫ মিনিট পর পর।
শুরুতে ১০ মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন চললেও পরবর্তীতে এই পার্থক্য আরও কমে যাবে । সামনে ৩ মিনিট পরপর মেট্রোরেল চলবে।
খোলা ও বন্ধের সময়
ঢাকা মেট্রোরেল সপ্তাহের ৬ দিন খোলা ও ১ দিন বন্ধ রাখা হয়েছে ।প্রথমদিকে মঙ্গলবার বন্ধ ছিলো। কিন্তু পরে তা শুক্রবার করা হয়। কারণ কর্তৃপক্ষের মতে রেলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ দিন বিরতি দেওয়া প্রয়োজন।
মেট্রোরেল চলাচলের সাধারণ নিয়মাবলি
বাংলাদেশে মেট্রোরেল বিষয়টা নতুন তাই এটি সম্পর্কে জনসাধারণের তেমন ধারণা নেই।আর সাধারণ রেল পরিবহনের চেয়ে মেট্রোরেলের ভেতরের পরিবেশ ভিন্ন হওয়ায় তা ঠিক রাখতে জনসাধারণকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।যেমন :
★ট্রেনে ওঠার আগে সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।আগে নামতে দিয়ে পরে ওঠার নিয়ম মেনে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। এমআরটি পাস থাকলেও একই নিয়ম প্রযোজ্য সবার জন্য।
★বিনা টিকিটে মেট্রোরেলে ভ্রমণ করা যাবে না।এমআরটি পাস সঙ্গে রাখতে হবে এবং সেটা না থাকলে সিঙ্গেল জার্নি টিকিট কেটে সঙ্গে রাখতে হবে।
★গন্তব্যস্থান সম্পর্কে ধারণা পেতে মেট্রোরেল ম্যাপ ,ট্রেনের ভেতরের নির্দেশিকা চিহ্ন ও ডিসপ্লে দেখতে হবে।কারণ যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেখানে দেওয়া থাকে।আর মনোযোগ দিয়ে ঘোষণা শুনতে হবে।
★স্টেশনের লিফটে ও ট্রেনের ভেতরে বয়স্ক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত স্থান ছেড়ে দিতে হবে।
★সিঁড়িতে বাঁ দিক ঘেঁষে দাঁড়াতে হবে।
★দৃষ্টিহীনদের যাতায়াতের জন্য হলুদ রঙের বিশেষ টাইলসের পথে দাঁড়ানো যাবে না।
★স্টেশন এলাকায় ধূমপান করা যাবে না এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। নির্ধারিত স্থানে থুথু ও পানের পিক ফেলতে হবে ।
★রেলের ভেতরে নিচু স্বরে কথা বলতে হবে।
★রেলের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো যাবে না।
★একজন যাত্রী একাধিক সিট দখল করে বসতে পারবে না।
★এখানে পানাহার করা যাবে না।
★ ট্রেনে কোনো ধরনের পোষা প্রাণী উঠানো যাবে না।
★এখানে কোনও পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখন ইত্যাদি লাগানো যাবে না।
সতর্কতা
মেট্রোরেল রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তাই এটি ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে ।নিচের সতর্কতাগুলো অবশ্যই বজায় রাখতে হবে :
★ট্রেনের ড্রাইভিং ক্যাবের দরজা খোলা যাবে না।
★মেট্রোরেলে ওঠা-নামার সময় মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ ।
★প্ল্যাটফর্মের দরজার ওপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে ট্রেন দেখার চেষ্টা করা যাবে না।
★স্টেশনের প্রবেশ গেট ও বহির্গমন গেট টপকানো যাবে না।
★ কোনো বিশাল বা ভারী পন্য উঠানো যাবে না।
★প্ল্যাটফর্ম ও মেট্রোরেলের কোচের মাঝের ফাঁকা স্থান বিপজ্জনক । তা এড়িয়ে চলতে হবে।
ঢাকা মেট্রোরেল ব্যবস্থা ঢাকা শহরের গতিশীলতাকে ব্যাপকভাবে উন্নত করবে, ভ্রমণের সময় হ্রাস করবে এবং বায়ুর গুণমান উন্নত করবে । ফলে শহরের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।