বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি সুন্দর জেলা হলো সুনামগঞ্জ।সিলেট বিভাগের অধীনে এই জেলাকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও রয়েছে এর।
সুনামগঞ্জ জেলার পরিচিতি,আয়তন কত,থানা কয়টি,সুনামগঞ্জ কিসের জন্য বিখ্যাত ইত্যাদি জানতে হলে পড়তে হবে পুরো লেখাটি।
সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থান কোথায়?
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা হলো সুনামগঞ্জ । সিলেট বিভাগের অন্তর্গত এই জেলা। এটি ভারতের সীমানার নিকটবর্তী একটি জেলা।
তাই এর উত্তর দিকে ভারতের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড় তথা মেঘালয়।পূর্বদিকে সিলেট জেলা, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা। এই জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী ও কুশিয়ারা নদী।
সুনামগঞ্জ জেলা কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়?
১৮৭৭ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়।পরে এই মহকুমা ১৯৮৪ সালে সুনামগঞ্জ নামে একটি জেলায় উন্নীত হয়।
সুনামগঞ্জ জেলার আয়তন কত?
সুনামগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের একটি ” এ ” শ্রেণির জেলা।এর আয়তন ৩,৭৪৭.১৮ বর্গ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের ৯ম বৃহত্তম জেলা এটি।এর ভৌগোলিক অবস্থান ২৪০৩৪ থেকে ২৫০১২৯০০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°৫৬ থেকে ৯১০৪৯ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।
এই জেলার নামকরণ কীভাবে হলো?
সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি ছোট ইতিহাস।জনৈক মুঘল সম্রাটের এক সিপাহীর নাম ছিলো সুনামুদ্দি বা সুনাম উদ্দিন । সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘সুনামদি’ বলা হয়।
কোন এক যুদ্ধে সিপাহি ‘সুনামদি’ বীরোচিত ভূমিকার জন্য সম্রাট কর্তৃক কিছু ভূমি পুরষ্কার হিসেবে পান। এই ভূমিই ছিলো বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলা।
তবে পরবর্তীতে এখানে তারই নামানুসারে সুনামগঞ্জ নামে বাজার গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তা থেকে মহকুমা ও মহকুমা থেকে জেলায় পরিণত হয়।এভাবেই সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
সুনামগঞ্জ জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
প্রাচীন ইতিহাস
অতি প্রাচীনকালে সুনামগঞ্জ জেলা পানির নিচে ছিল। জানা যায় এটি রত্নাকর বা কালিদহ নামক বিশাল সমুদ্রের অংশ ছিল। যা পশ্চিমে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে পূর্বে ত্রিপুরার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বহু শতাব্দী ধরে পলিমাটির কারণে সমুদ্রতল বাড়তে শুরু করে। কালে কালে পলি জমে ও ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এখনকার ভূখন্ডে পরিণত হয়েছে।
প্রথমে ভূখণ্ডটি প্রবালপ্রাচীর আকারে উন্নীত হতে শুরু করে এবং তারপর জেলার বেশিরভাগ অংশ সমুদ্রের তলদেশ থেকে উত্থিত হয়।
সুনামগঞ্জের ভূগর্ভের চুনা পাথর ও কয়লা খনি আবিস্কার এই তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করে। এই জেলার হাওর, বাওরের আকৃতি,প্রকৃতিও একই তথ্য নির্দেশ করে।
প্রাচীনকালে সুনামগঞ্জ ছিল ‘লাড়’ (লাউর) রাজ্যের অংশ যা সিলেটের পশ্চিম অংশ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের উত্তর অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে।
১৩ শত সালের আগ পর্যন্ত এখানে হিন্দু রাজাদের রাজত্ব ছিল। পরে হযরত শাহ জালাল ইয়ামানীর আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনায় মুসলমানদের দ্বারা ১৩০৩ সালে সিলেট (গৌড় রাজ্য) জয়ের পর, হযরত শাহ কামাল কুহাফাহ তার বারোজন শিষ্য এবং তার দ্বিতীয় পুত্রের সহায়তায় সমগ্র লাউড় রাজ্যকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
তারা শাহারপাড়ায় রাজধানী স্থাপন করেন। শাহ জালাল (রঃ) এর দ্বিতীয় পুত্র শাহ মুয়াজ্জাম উদ্দিন কোরেশী সুরমা নদীর তীরে নিজগাঁওয়ে একটি উপ-প্রশাসন কার্যালয় স্থাপন করেন যা বর্তমান সময়ে ষোলঘর (সুনামগঞ্জের একটি গ্রাম) নামে পরিচিত।
১৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলা ইকলিম-ই-মুয়াজ্জামাবাদের বা মুয়াজ্জামাবাদ রাজ্যের একটি অংশ ছিল। কিন্তু ১৬২০ সালে এটি দিল্লির পরাক্রমশালী মুঘলরা জয় করে নেয়।
মুয়াজ্জামাবাদের শেষ সুলতান ছিলেন আবদুল হামিদ কোরেশী, যিনি শমসের খান কোরেশী নামে পরিচিত ছিলেন। ১৭৪০ সালে গিরিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত একটি যুদ্ধে জালালাবাদের (বর্তমান সিলেট) পতন ঘটে।জালালাবাদ এর পতনের পর শমসের খান কুরাইশি নবাব-কাম-ফৌজাদারের পদ গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন আন্দোলন ও বিদ্রোহে অবদান রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ১৯২২-২৩ সালে সুখাইরের নানকার বিদ্রোহ।
সুনামগঞ্জ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আবাসস্থল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর অনেকে বামপন্থী আন্দোলন ব্যাপ্ত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সমগ্র জেলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক হত্যা, নারী ধর্ষণ ও সহিংসতা চালায়। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল ছাতক উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনী ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এবং ১১ জনকে আহত করে। ২৯ জুলাই জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজারে এনকাউন্টারে মুক্তিবাহিনীর এক সদস্য নিহত হন।
১১ আগস্ট তেলিয়া গ্রামে ৮ জন বেসামরিক লোক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়। ২৫ আগস্ট দিরাই উপজেলায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং দুজন আহত হয়।
জগন্নাথপুর উপজেলার স্থানীয় রাজাকাররা ৩১ আগস্ট শ্রীরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি তথাকথিত শান্তি সভা বসায় এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং জনগণকে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয়।
এই বৈঠকে পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় ১২৬ জনেরও বেশি লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনার কয়েকদিন পর ৮ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা রাণীগঞ্জে ৩০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং প্রায় ১৫০টি দোকান লুট করে।
সুনামগঞ্জ শহর, কৃষ্ণনগর ও আহসানমারা ফেরি ঘাটে এখানকার মানুষেরা পাক সেনাবাহিনীর নিয়মিত লাঞ্চনার শিকার হয়। সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউস ও আহসানমারা এলাকায় জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের ফলে তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।মঙ্গলকোটের কৃষ্ণনগরে যুদ্ধে ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয়। ৪টি গণকবর, ৩টি বধ্যভূমি, ৩টি স্মৃতিফলক, ৫টি স্মৃতিস্তম্ভ এখনও জেলার মানুষের আত্মত্যাগকে সমুন্নত করে।
প্রশাসনিক উপজেলা ও থানার নামসমূহ
সুনামগঞ্জ জেলা সিলেটের অন্যতম প্রশাসনিক অঞ্চল। তাই এই জেলার গুরুত্ব অনেক।এই জেলাকে শাসন করার সুবিধার্থে উপজেলা,থানা,পৌরসভা, ইউনিয়ন, গ্রামে ভাগ করা হয়েছে।
এই জেলায় মোট ১২ টি উপজেলা রয়েছে।যথা:
১.বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা
২.ছাতক উপজেলা
৩.দিরাই উপজেলা
৪.ধর্মপাশা উপজেলা
৫.দোয়ারাবাজার উপজেলা
৬.জগন্নাথপুর উপজেলা
৭.জামালগঞ্জ উপজেলা
৮.শাল্লা উপজেলা
৯.সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা
১০.তাহিরপুর উপজেলা
১১.শান্তিগঞ্জ উপজেলা
১২.মধ্যনগর উপজেলা
এই জেলায় মোট ১২ টি থানা রয়েছে।এছাড়াও আছে ৪টি পৌরসভা, ৮৮টি ইউনিয়ন, ১৫৩৫টি মৌজা, ২৮৮৭টি গ্রাম ও ৫টি সংসদীয় আসন ।
সুনামগঞ্জ জেলার বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গের নাম
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দূরবীন শাহ, ক্বারি আমির উদ্দিন,সৈয়দ শাহনুর,
সৈয়দা শাহার বানু, মানিক লাল রায়, মুহিবুর রহমান মানিক, আব্দুস সামাদ আজাদ, এম এ মান্নান,
কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন, কামাল উদ্দিন, কাঁকন বিবি, রামকানাই দাশ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, শাহ মোহাম্মদ ইসকন্দর মিয়া, শাহেদ আলী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুষমা দাস,
আছিম শাহ, আনোয়ার চৌধুরী, আবুল হাসনাত আব্দুল হাই,সুহাসিনী দাস প্রমুখ।
সুনামগঞ্জ জেলার বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম
১.অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক,
২.জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল মোমেন
৩.বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান
৪.দোয়ারাবাজার উপজেলার সাবেক কমান্ডার সফর আলী
৫ সদর উপজেলার সাবেক কমান্ডার আব্দুল মজিদ
৬.বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সামছুল হক
৭.জেলার প্রথম শহীদ আনসার সদস্য সিরাজুল ইসলাম
৮.শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম
৯.বীরাঙ্গনা মোছা. জমিলা
১০.মোছা. কুলছুম বিবি
১১.মোছা. পেয়ারা বেগম
১২.মোছা. মুক্তাবানু
১৩.আলিফজান বিবি
১৪.প্রমিলা দাস
সুনামগঞ্জ জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত?
সুনামগঞ্জ জেলা বিখ্যাত মূলত এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে।এখানকার মূল আকর্ষণ হাওর,বাওর ও বিল। এসব জলাশয়ে রয়েছে ভাসমান নৌকার ঘর যেখানে পর্যটকদের জন্য থাকা খাওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত।
সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম খ্যাতি লোকসাহিত্য ও লোক সংগীতে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অসংখ্য সরব উপাদানের উৎপত্তি এখানেই । আর বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত, দূরবীন শাহ, ক্বারি আমির উদ্দিন সহ আরো অনেক আউল-বাউলের চারণভূমি সুনামগঞ্জ।
এই জেলা অর্থনৈতিক ভাবেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারণ এই জেলা ধান, মাছ, সিমেন্ট, বালু,পাথর প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। আর এই সম্পদ থেকে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
১. টাঙ্গুয়ার হাওর সহ জেলার অন্যান্য হাওর ও বিল
২.হাছন রাজার বাড়ি
৩.হাওলি জমিদার বাড়ি
৪.গৌরারং জমিদার বাড়ি
৫.বাউল আব্দুল করিম স্মৃতি যাদুঘর
৬.নারায়ণতলা
৭.সৈয়দপুর গ্রাম
৮.পাইলগাঁওয়ের জমিদার বাড়ি
৯.বাঁশতলা শহীদ স্মৃতিসৌধ
১০.লাউড়েরগর
১১.বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম মিউজিয়াম ধল
১২.শ্রী শ্রী ঠাকুরবাণীর থলা
১৩.শাহ আরেফিন মাজার
১৪.টাঙ্গুয়ার হাওর
১৫.শিমুল বাগান
১৬.নীলাদ্রি লেক
১৭.নারায়ণতলা মিশন
১৮.পণতীর্থ স্মৃতি ধাম
১৯.ডলুরা স্মৃতি সৌধ
২০.টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প
২১.সুখাইড় জমিদার বাড়ী
২২.শাহ কালাম কোহাফাহ্ (রহ.)-এর রওজা
২৩.সিরাজ উদ্দীন লেক
২৪.সাচনা জমিদার বাড়ি