মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি

মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি

নাম যখন সময়ের চেয়ে দীর্ঘজীবি হয়! ঘোড়াশাল জমিদার বাড়ি। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রের মিঞাপাড়া গ্রামে ১০০ বছর আগে এই জমিদার বাড়ির নির্মাণ। কিন্তু লোকমুখে ঘোড়াশাল জমিদার বাড়ি নয়, মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি নামে বেশি প্রচলিত এই আড়াইশো বছরের পুরাকীর্তির। যে মনু মিয়ার নামে প্রচলিত এই  প্রাচীন স্থাপনাটি কে সেই মনু মিয়া? জেনে নেওয়া যাক।

জমিদার আবু ইউসূফ লুৎফুল কবির ফেনু মিয়া ছিলেন ঘোড়াশাল জমিদার বাড়ির জমিদার। পাশাপাশি তিনটি বাড়িতে ফেনু মিয়া, নাজমুল হাসান ও মৌলভী আব্দুল কবিরের বসবাস ছিলো।মূলত এই তিন বাড়ি মিলেই ছিলো বিশাল জমিদারি। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে এই সুবিশাল জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন জমিদার সাজদা মিয়া। 

জমিদারির যাবতীয় কার্যাবলী, খাজনা আদায়,বিচার-আচার,সালিশ, ব্রিটিশদের আনাগোনা, আপ্যায়ণ সব ছিলো ফেনু মিয়ার বাড়িতেই। লোকমুখে প্রচলিত এই বাড়ির সামনে দিয়ে পথচারীদের জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটাতেও ছিলো নিষেধাজ্ঞা। আরও প্রচলিত রয়েছে, ঘোড়াশাল রেলওয়ে স্টেশন যে জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে তাও এক সময় এই জমিদারের অধীনে ছিলো। জমিদার ফেনু মিয়ার ই পুত্র ছিলেন মনু মিয়া। 

১৯২৩ সালে মনু মিয়ার জন্ম। ছাত্রজীবনে তিনি ১৯৪২-৪৩ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং দুই বছর পর  ডাকসু নির্বাচনে প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশুনা শেষে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া দিয়ে। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পাকিস্তান এ কর্মযুক্ত হন। মনু মিয়া তার কর্মজীবনের সফলতার পাশাপাশি দুইবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন। মনু মিয়ার কর্মজীবন সমাপ্ত হয় সাংবাদিকতা পেশা দিয়ে। তিনি  প্রথমে দৈনিক সংবাদ এর সম্পাদক এবং পরে প্রধান সম্পাদক হিসাবে কর্মরত অবস্থায় ২০০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।কর্মজীবনে তার এই সফলতাগুলো তাকে এক অন্যরকম সম্মানের স্থানে নিয়ে যায়। যে কারণে এই বাড়ির নাম তার নামানুসারেই সর্বাধিক প্রচলিত হয়ে এসেছে। এমনকি মনু মিয়ার স্ত্রী,পুত্রের কর্মজীবনের সাফল্যও বাংলাদেশের উন্নতি সাধনে বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। এভাবেই এক বিশাল জমিদার বাড়ির সমগ্র ইতিহাস রচিত হয়ে যায় এক উত্তরসূরি, জমিদার পুত্র মনু মিয়ার নামে। 

ঘোড়াশালের এই জমিদার বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশুনার দায়িত্ব রয়েছে এই পরিবারেরই ব্যক্তিগত মালিকানায়। তাই এটিকে কোনো দর্শনীয় স্থান হিসাবে উন্মুক্ত করা হয়নি আজও। তবে সৌভাগ্যক্রমে অনুমতি আদায় সাপেক্ষে দর্শন মেলে বাড়ির আঙিনা ও চারপাশের সবুজ রাজ্য দেখার। দলবেঁধে ভ্রমণের জায়গা নয় এটি। একান্তই ইতিহাস জানার আগ্রহ থাকলে দুই তিন জন মিলে নিরিবিলি গিয়ে দেখে আসতে পারেন ব্রিটিশ আমলের এই ঐতিহ্যটি।

জমিদার এই বাড়িটি দশ একর জমির উপর দাঁড়ানো সুবিশাল এক কাঠামো যা বাইরে থেকে ধারণা করা মুশকিল। ভেতরে প্রবেশে দেখা মেলে প্রধান ফটকের পাশেই ছোট এক মসজিদের। লোকমুখে শোনা যায় একসময় এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন  জমিদার বাড়ির সদস্যরা। 

বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে শুধু সবুজের বিস্তৃতি। পুরোনো বড় বড় গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। শান বাঁধানো বড় দুটি পুকুর ঘাটে রয়েছে চেয়ার-টেবিল দিয়ে বসার ব্যাবস্থা। বাড়ির আঙিনা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ল্যাম্পপোস্ট।  যা দেখলে বোঝা যায় একসময় আলোয় ঝলমল করতো এই বাড়িগুলো। একপাশে রয়েছে একটি পরিত্যাক্ত কুয়া।  দেখা মিলবে জরাজীর্ণ, রঙ ওঠা ফোয়ারার। দেখে মনে হয় ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেনো। পুরো বাড়ির গঠনে নান্দনিকতার ছোঁয়া দেখে মনে হয় সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলো জমিদারেরা রুচি ও মনোভবে।  সাদা একতলা বাড়ির বড় বড় জানালাগুলো এনেছে অদ্ভুত সৌন্দর্য। বাড়ির চারদিকের উঁচু প্রাচীরগুলোতে জমেছে শ্যাওলা। জায়গায় জায়গায় চটেছে রঙ। রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এত বছরেও বেশ পরিচ্ছন্ন আর ছিমছাম রয়েছে বাড়ির  অন্দরমহল। তবুও রংচটা দেয়াল, জায়গায় জায়গায় খসে যাওয়া ইট সুড়কির ভাংচুর জানান দেয়  বাড়ির বয়স হয়েছে অনেক। আঙিনায় দেখা মেলে চার রকমের কাঠগোলাপ গাছের। সামনে পিছনের মাঠগুলো ঘাস, গাছপালা দিয়ে আবিষ্ট থাকায় মনে হয় সবুজ এক চাদর ছড়িয়ে আছে যেনো। বাড়ির ভেতরে যেটুকুতে দৃষ্টিপাত করা যায় দেখা মেলে বিলাসবহুল চেয়ার, টেবিল, আসবাবপত্রের। বিশাল জানালাগুলো পর্যাপ্ত আলো, ছায়া, বাতাস এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করছে। আধুনিকতা, নান্দনিকতা এবং প্রাচীন মিলেমিশে একাকার করেছে এই নিদর্শনটি। বাড়ির প্রতিটা ইট, সুড়কি,বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া গাছগুলো ইতিহাসের প্রতিদিনের সাক্ষী বহন করে চলেছে।

যাবেন কিভাবে ?

ঢাকার মহাখালী থেকে পি পি এল, উত্তরা, চলনবিল কিংবা নরসিংদী-ভৈরবগামী যেকোন বাসে উঠে জনপ্রতি ৮০-১৫০ টাকা ভাড়ায় ঘোড়াশাল নেমে অটো রিকশায় খুব সহজেই পৌছে যাওয়া যাবে এই বাড়ির ঠিকানায়।  এছাড়া ঢাকা থেকে নরসিংদীগামী ট্রেনে উঠে ঘোড়াশাল স্টেশন পর্যন্ত জনপ্রতি ৮০/১০০ টাকা ভাড়া গুণে স্টেশনে নামলে সেখান থেকেও যাওয়া যাবে এই জমিদার বাড়িতে।পাশাপাশি তিনটি বাড়ির ভেতর একটি বাড়িতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন রয়েছে অনুমতির। বাকি দুটি বাড়িতে প্রবেশ এবং ঘুরে দেখায় নেই কোনো সতর্কবার্তা।

প্রতিটি দর্শনার্থীর কাছে নিবেদন, নিজেদের দ্বারা যেনো বিন্দু পরিমাণ ক্ষতিসাধন না হয় সময়কে ধরে রাখা এই ঐতিহ্যটির। ইতিহাস আমাদের গৌরবময় সম্পত্তি আর মনু মিয়ার এই জমিদার বাড়িটি সেই ইতিহাসের ই এক অনন্য সম্পদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!