রাঙামাটি ভ্রমণ কাহিনী

রাঙামাটি ভ্রমণ কাহিনী
শেয়ার করুন সবার সাথে

আমার রাঙামাটি ভ্রমণ কাহিনী এবং কিছু কথা

রাত্রি তখন আটটা কিংবা তার ওপরে বাজে। সিএনজি এগিয়ে চলছে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে কিন্তু বুকের ভিতরে দুরুদুরু ভাবটা বেড়েই চলেছে। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছিল সিএনজি ছাড়ার পরপরই। বৌ আমার কোন কথা বলতেছে না, শুধু ১৫-২০ মিনিট পর পর সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করছে আর কত দূর। আমাকে তেমন কোন কিছু বলছে না। কিন্তু আমার মনের খটকা-টা ক্রমশ বেড়েই চলছে। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না । এদিকে ক্ষিনক বাদে বাদেই সিএনজির আলোতে চোখ পড়ছে রাস্তার পাশে থাকা মাইল ফলকের মাঝে। একি বান্দরবান ১২০ কি:মি: লেখা কেন? তাহলে সে আমাদেরকে বান্দরবানে নিয়ে যাচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতেই অনেক উল্টা-পাল্টা চিন্তা এসে পড়তেছে। একসময় তো ড্রাইভারকে বলেই ফেললাম একটু সাইড করতে। উদ্দেশ্য একটাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার নামে কাউকে জিজ্ঞাসা করা এটা কাপ্তাই যাওয়ার রাস্তা কিনা? কিন্তু ড্রাইভার এমন জায়গায় থামালো যেখানে একটা খুপরির মতো বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। পড়লাম না মহাবিপদে। যাই হোক, কপাল ভালো বাড়ির সামনে একটা বুড়ো লোক দেখতে পেলাম। সাধারনত রাত ৭-৮ টার পরে এরা বাড়ির বাহিরে থাকে না। এদিকে ড্রাইভার বলতেছে আপনি ওইদিকে কই যাইতেছেন। সে যাই বলুক আমার কাজ তো আমাকেই করতে হবে। খোঁজ খবর তো নিতে হবে।

ইতিমধ্যে নিজেকে খুব অপরাধী অপরাধী লাগা শুরু করল। কারন আমার জন্যই এমন পরিস্থিতি হয়েছে। নচেৎ এতক্ষনে কাপ্তাই এ থাকার কথা। এসবই আজ আমার জন্য। আমি যদি শুভলংয়ের যাওয়ার জন্য ওতো না উতলা হতাম, যদি বিকাল হওয়ার পূর্বেই ঝুলন্ত ব্রীজের কাছে চলে আসতাম তাহলে হয়তো এই ধরনের বিব্রতকর পরিস্হিতিতে পড়তে হতো না। ভাবতেছিলাম বৌকে কি জবাব দিবো? পোলা আমার তো কিছুই বুঝে না। অবশ্য বুঝার কথাও না। সে তো ঘুমে বিভোর।



এই ঘুটঘুটে অন্ধকার শীতের রাতে সিএনজি যখন এইভাবে পাহাড়ি আঁকাবাকাঁ রাস্তায় এগিয়ে চলছিল তখন বুকের ভিতরটা কেমন কেমন যেন করে উঠছিল। মোবাইলে নেটওয়ার্কও দেখাচ্ছে না। ছোট ভাইটাকে ফোন করে যে কিছু জানবো সেটাও পারতেছি না। মনে হচ্ছিল আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অজানা গন্তব্যে। যাই হোক যা বলতেছিলাম, ওই বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল এটাই কাপ্তাই যাওয়ার রাস্তা। ইতিমধ্যে ড্রাইভার কাছে এসে পড়াতে দেখলাম মারমা লোকটি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতেছে যা ওদেরকে নিয়ে যা, কোন শয়তানি করিছ না। আমি তো অবাক। শয়তানি বলতে লোকটা কি বুঝাতে চাচ্ছে? তাহলে কি আমি যা এতক্ষন ভাবতেছিলাম তাই ঘটতে যাচ্ছে। গলাটা আমার ভয়ে সংকুচিত হয়ে আসছিল। কিছুক্ষন পর লোকটা আবার আমাকে আশ্বস্ত করে জানালো ভয়ের কিছু নাই ও আমাদের জামাই। কিন্তু তাতেও আমার মন গললো না তার আশ্বস্তিতে। পরে ড্রাইভারকে বললো যা ওদেরকে নাসিরের কাছে নিয়ে যা। আমি তো থ। এই নাসির আবার কে।

এই পর্যন্ত এসে সবাই হয়ত ভাবতেছেন এ আবার কি বলতেছে ভ্রমন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, কিসে রে কিসের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে? জি হ্যা ধরতে পেরেছেন। এটা কোন থ্রিলিং স্টোরি নয়। এটা ছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ভয়ংকর পাহাড়ি রাতের সত্যিকারের রাঙামাটি ভ্রমণ কাহিনী। যা ছিল আমার জন্য অকল্পনীয় একটি রাত্রি।

এখন আসি জেনে নেওয়া যাক গল্পটা তুলে ধরার পিছনে লক্ষ্য কি ছিল আমার। আমার কথা একটাই আপনি যখন যেখানেই যান না কেন অর্থাৎ যে স্পটই ঘুরতে যান না কেন আগেই ঠিক করে নিবেন আপনার সেখানে যাওয়া আসার সময়টা ফিক্শিড করে নিবেন। তারে মানে আপনি কোন সময়ে স্পটে যেতে চান এবং কখন সেখান থেকে ফিরতে চান। এইজন্য ওই স্পটে সম্প্রীতি গিয়েছে এমন অভিজ্ঞ দুই একজনের সাথে আলাপ করে আগেই জেনে নিতে হবে। আর তা না হলে আমাদের মত অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্হায় পড়তে হবে। পরে অবশ্য আমরা গন্তব্যস্হলে পৌছঁতে পেরেছিলাম। বেচারি ড্রাইভার ভাই অবশ্য আমার ব্যাপারটা মাইন্ড করেছিলো। আমারও আসলে কিছু করার ছিল না ওইরকমটি করা ছাড়া।

# যাই হোক এবার বলি রাঙামাটিতে (কাপ্তাই এবং তার চারপাশে) এলে কি কি দেখতে পারেন আই মিন স্পটস নেম।

১. জুম রেস্তোরাঁ ( বিজিবি ক্যাম্পে অবস্থিত )

২. লেক প্যারাডাইস ( নেভি ক্যাম্পে অবস্হিত )

৩. লেকসোর ( আর্মি ক্যাম্পে অবস্হিত )

# হালের ক্রেজ কায়াকিং করতে পারবেন জুম রেস্তোরার লেকে, ঘন্টা প্রতি ২০০ টাকা।

উপরের এই ৩ টি স্পটে যেতে হলে আপনাকে কাপ্তাইয়ে যেতে হবে। ৩ টি স্পটেই থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। আমরা ছিলাম জুম রিসোর্টে। ভাড়া পড়েছিল ১৫০০ টাকা।

অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

৪. ঝুলন্ত ব্রীজ ( আমার কাছে এটা ততটা আকষর্নীয় ছিল না। মনে হল এখানে মানুষ দেখতে এসেছি। বারটি শুক্রবার হওয়ার কারনেই বোধ হয় এমন মনে হয়েছে। )

৫. শুভলং ( এখন ঝর্নার লেষ মাত্রও নেই, তবে সেখানে যাওয়ার পথটা অসাধারন )

৬. স্বর্নমূর্তি ( শুভলং এ যাওয়ার পথেই এটি দেখতে পাবেন বোট থেকে )

৭. রাজবন বিহার ( বর্তমানে যাওয়া নিষেধ আছে )

৮. পাহাড়ি গ্রাম

এছাড়া আরো কিছু স্পটের নাম শুনে থাকবেন যেগুলো মূলত স্পট না।

??☕?পাহাড়ি খাবার খাওয়ার হোটেল বলতে পারেন। একটাতে খেলাম। খাবারের মান ততটা ভালো লাগলো না। এই সমস্ত খাবারের হোটেলের আইটেমগুলো মোটামুটি সব একি ধরনের। যেমন: ব্যাম্বো চিকেন, রুই মাছ, ডাল, লেকে মাছের ভর্তা আরো কি কি যেন আছে এখন মনে আর মনে আসছে না। খাবার যাই হোক দাম কিন্তু সেই লেভেলের। মনে করেন ৩ জনের জন্য শুধু ভাত, ডাল, ভর্তা অর্ডার করলে বিল আসবে ৪০০ টাকার মত।

???? রাঙামাটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে বনর্না করতে গেলে হয়ত পেজের পর পেজ লেখা যাবে, কিন্তু উপলব্ধি করতে হলে এখানে সশরীরে আসতে হবে।



রাঙামাটির সৌন্দর্য আসলে ছবির চেয়েও অনেক সুন্দর। মনে হবে এখানেই সাড়াটা জীবন থেকে যাই। লেকের নীল জলরাশি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। হঠাত হটাতই মনে চাইবে ইশ্ এই সুউচ্চ পাহাড়ের ওপরে যদি উঠতে পারতাম। আচ্ছা ওই যে পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, ওইখানে যদি একটা দিন থাকতে পারতাম তাহলে কতই না আনন্দ লাগতো। পাহাড়ের পাড়ে পাড়ে আর খাঁজে খাঁজে পাহাড়িদের বাড়িগুলো দেখে আপনি বুঝতে পারবেন পাহাড়ি আদিবাসিরা কতটা কর্মট আর সাহসী। এতো গহীন জনপদে তাদের আনাগোনা আপনাকে কি পরিমান সাহস জোগাবে তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। লেকে ভ্রমনের আগে মাঝি ভাইয়ের সাড়াদিনের প্যাকেজের কথা শুনে হয়ত আপনার চোক্ষ চরকগাছে চরতে পারে কিন্তু বিশ্বাস করুন লেকের দুই ধারের সুবিশাল পাহাড়গুলোর গাছপালা যখন সূর্যের আলোর উপস্হিতিতে আরেকবার অনুপস্থিতিতে দৈত্ব রূপ ধারন করবে তখন আমনাআমনি-ই আপনার সারাদিনের ভ্রমনের ক্লান্তিবোধটিকে বারংবার প্রশমিত করবে। যদি রাতে রাঙ্গামাটিতে থাকার পরিকল্পনা থাকে তাহলে গোধুলি লগ্নের শেষ রশ্মিটুকু দেখতে ভুলে যাবেন না।

আসবেন কিভাবে আর থাকবেন কোথায়

ট্রেনে আসতে চাইলে রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে তূর্না বা মহানগর এক্সপ্রেসে করে চট্টগ্রামে আসবেন। ভাড়া পড়বে ৩৪৫ টাকা। তারপর অক্সিজেন মোড় থেকে পাহাড়িকা বাসে করে সরাসরি রাঙামাটি চলে যাবেন। ভাড়া পড়বে ১৩০ টাকা। আর আপনি যদি ২ দিন ( ১ দিনে কাপ্তাই কাভার করা বেশ কষ্ট সাধ্য হয়ে যাবে) কাপ্তাইয়ে ঘুরে ৩য় দিনে কাপ্তাই লেকে ঘুরেন তাহলে সুন্দর একটা ভ্রমন হবে আপনার জন্য। আমার প্ল্যান ছিল প্রথমে কাপ্তাইয়ে যাব তারপর ১ রাত থেকে পরেরদিন রাঙামাটিতে যাব ঝুলন্ত ব্রীজ দেখতে। তবে আমার এই প্ল্যানে কিছু ত্রুটি ছিল। যা সংশোধন করে আপনাদের একটা প্ল্যান করে দিচ্ছি। আগেই বলে রাখি এই প্ল্যান তাদের জন্যই উপযুক্ত হবে যারা আগে কাপ্তাইয়ে যেয়ে পরে রাঙামাটিতে( স্হানীয় লোকজন জায়গাটার নাম পর্যটন বলে সংবোধন করে ডাকে। অর্থাৎ ঝুলন্ত ব্রীজ পর্যটন কর্পোরেশন এর অধীনে হওয়ার কারনেই এই নাম। তাছাড়া সেখানে পর্যটন কর্পোরেশনের একটা হোটেল থাকার কারনেও এই নাম প্রচলিত হতে পারে। )



এবার আসুন ট্যুর প্ল্যানটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেমন,মনে করেন আপনি রাতের ট্রেনে চট্টগ্রামে আসলেন ভোর ৫:৩০ এ। স্টেশন থেকে সিএনজি বা রাইডারে করে চলে যাবেন বদ্দারহাট বাস টার্মিনালে। বাস টার্মিনাল থেকে চন্দ্রঘোনার উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে। চেষ্টা করবেন প্রথম ট্রিপটা ধরার। সাধারনত ৬ টা থেকে ৬:৩০ টার মধ্যে প্রথম ট্রিপ পাওয়া যায়। এরপরও আরো ট্রিপ আছে। চন্দ্রঘোনায় বাস থেকে নেমে সিএনজি নিয়ে সরাসরি চলে যাবেন জুম রেস্তোরায়। ভাড়া পড়বে ১২০-১৫০ টাকা। সেখানে টিকেট কেটে ঘন্টাখানেক ঘুরে কায়াকিং করতে পারেন ১ ঘন্টা। বেলা ১ টার দিকে খাওয়া দাওয়া করে ( জুম রেস্তোরার পাশে অবস্থিত কায়াকিং ক্লাবের পাশে একটা ছোট খাটো রেস্তোরা আছে। খুব সুন্দর মনোরম পরিবেশ। খাবারে দামও খুব সস্তা।) একটা সিএনজি রিজার্ভ (ভাড়া ৫০০-৭০০ টাকার মত পড়বে) নিয়ে সরাসরি চলে লেকপ্যারাডাইস আর লেকসোর দেখতে। এই দুইটি জায়গাই দেখতে খুব সুন্দর। দুটি স্পট-ই পাশাপাশি অবস্থিত। জুম রেস্তোরা থেকে সিএনজি না পেলে বড়ইছড়ি যাবেন, সেখান থেকে রিজার্ভ করবেন। আর রিজার্ভ করার সময় বলে নিবেন লেক প্যারাডাইস, লেকসোর এ ঘন্টা দুয়েক ঘুরিয়ে সন্ধ্যার আগেই যেন রাঙামাটি শহরে যেন পৌঁছে দেয়। রাঙামাটিতে কিছু ভালো হোটেল আছে। আমি পরামর্শ দিবো হোটেল সোফিয়াতে ওঠার। আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখবেন। না হলে রুম খালি পাবেন না। রাতে সেখানে থেকে সকাল সকাল ঝুলন্ত ব্রীজ দেখে সেখান থেকে একটা বড় ট্রলার ভাড়া করবেন সারাদিনের জন্য। ভাড়া পড়তে পারে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। শুভলংয়ে যাওয়ার নদীপথটি খুবই সুন্দর। না দেখলে বুঝানো সম্ভব নয়। যাই করেন না কেন চেষ্টা করবেন সন্ধ্যার আগে আগেই ফিরে আসার।

এই হলো মোটামুটি একটা ভ্রমণ কাহিনী। এতে যদি কারো উপকারে আসে তাহলে আমার এই লেখাটা স্বার্থক বলে গন্য করবো।

আর একটা কথা আপনি যেই স্পট-ই যান না কেন জায়গাটা নোংরা করে আসবেন না, কারন এসব জায়গায় ময়লা শোভা পায় না।

সবাই ভালো থাকুন। সুস্হ থাকুন।

হ্যাপি ট্রাভেলিং ☺

ছবিঃ Monzur Khan


শেয়ার করুন সবার সাথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!